উত্তাল ২৯ মার্চ ১৯৭১ সোমবারঃ মৌলভীবাজার পর্যটন রেস্ট হাউজে অবস্থান গ্রহণ করে মেজর সি আর দত্ত, কর্ণেল রব, মেজর নুরুজ্জামানের নের্তৃত্বে মুক্তিযুদ্ধারা সিলেটের পথে রওয়ানা হলে শেরপুরে চারদিন তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ন্যাপ নেতা বিজয় ভৌমিকের বড়ভাই লন্ডন প্রবাসী সুনীল ভৌমিক শহীদ হন। পাক বাহীনি সে যুদ্ধে শেরপুরে টিকতে না পেরে সিলেট অভিমুখে পশ্চাতগমণ করে সাদিপুরে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনীর বিমান হামলার মুখে মুক্তিযুদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকে। এ সময় র্দুধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আজিজ মারাত্মকভাবে আহত হন। হানাদাররা সিলেট দখল করে জল, স্থল ও অন্তরীণে আক্রমণ করতে থাকলে মুক্তিবাহিনীরা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়
বিকেল ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সমাবেশের কাজ সম্পন্ন হয়। ব্যাটালিয়নের অফিসার এবং সৈনিকদের টাউন হলে একত্র করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। ২৯শে মার্চ ২য় বেঙ্গল কিশোরগঞ্জে আসে। মেজর মইনুল হাসান, মেজর নূরুল ইসলামও ছিলেন। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে পাক বিমান ভৈরবের ওখানে বোমা ফেলে এবং কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে যায়। রাতে পুরা ব্যাটালিয়ন (৮০০) ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যায়।
২৯ মার্চ পাবনা সদর উপজেলার মালিগাছায় (পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়ক সংলগ্ন) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের এক রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। বক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে আটঘরিয়া থানা পুলিশের এসআই আব্দুল জলিলসহ বেশ ক’জন মুক্তিকামী যোদ্ধা শহীদ হন। এ যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানী সেনাও খতম হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সারা দেশের ন্যায় ঈশ্বরদীতেও মুক্তিযুদ্ধারা সংগঠিত হতে থাকেন। শহর-গ্রামে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ২৯ মার্চ সকালে ঈশ্বরদীতে খবর আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সাজোয়া বহর পাবনা থেকে বিতাড়িত হয়ে পাবনা শহরের পশ্চিম প্রান্তের মাধপুর কাঁচা রাস্তা ধরে (বর্তমানে পাকা রাস্তা) ঈশ্বরদীর দিকে এগিয়ে আসছে; কেননা পাবনা রোড আগেই বড় বড় গাছ কেটে ও মাটি খুঁড়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যানবাহণ চলাচলের অযোগ্য করে ফেলা হয়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে রাখা বন্দুক, এয়ার গান, দেশীয় অস্ত্র, ঢাল, সড়কি, লাঠি-সোটা এমনকি ইট-পাথর নিয়ে একযোগে মাধপুর রাস্তার বটগাছের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গ্রামবাসী ও মুক্তিযুদ্ধাদের সংগে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। মাধপুর বটতলায় গাড়িবহর থেকে বৃষ্টির মত গুলি চালায় পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা মূলত স্বউদ্যোগে কোনো উর্ধতন কমাণ্ড ও নেতৃত্ব ছাড়াই শুধুমাত্র সাহস ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একরকম খালিহাতে একটি রেগুলার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ঈশ্বরদী কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান রাজু। এছাড়া সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক, ওহিদুর রহমান, আব্দুল গফুর, নুরুল ইসলাম, আলী আহমেদ, নবাব আলী মণ্ডলসহ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৫০ জন গ্রামবাসী। পরে পাকিস্তানিবাহিনী সেখান থেকে পালিয়ে সন্ধ্যার দিকে দাশুড়িয়ার তেঁতুলতলায় উপস্থিত হলে সেখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা প্রবল বাধার সন্মুখীন হয়। এখানে থানা পুলিশের একটি অংশ ও আনছার বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রে সন্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন। এরপর পাকবাহিনীর অবশিষ্ট অংশটি পথে মুলাডুলি ও রাজাপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা একইভাবে আক্রমনের শিকার হয় এবং ৩০ মার্চ নাটোরের ময়না গ্রামে পৌঁছে সমূলে ধ্বংস হয়।
ময়নার যুদ্ধে ৩৫ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতা শহীদ হন ও আরো ৩২ জন আহত হন। যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনাও নিহত হয়। পাক সেনাদের ছোঁড়া শেল-এ পার্শ্ববর্তী চামটিয়া গ্রামে ৩ জন শহীদ হন। শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষের গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তিপাগল জনতা, ইপিআর ও আনছার বাহিনীর হাতে পাক বাহিনীর পুরো দলটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু পরদিন সকালে ছদ্মবেশে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা বেশ কয়েকজন পাকহানাদার সদস্য ও তাদের কমাণ্ডার আসলাম রাজা খান ধরা পড়লে তাদেরকে পরে লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট হাইস্কুলের মাঠে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই যুদ্ধকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ময়নার যুদ্ধ বলা হয়। যুদ্ধে যেসব প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন: সৈয়দ আলী মোল্লা, মোসলেম আলী মোল্লা, আবুল কাশেম মোল্লা, আয়েজ উদ্দিন মোল্লা, খন্দকার নুরুন্নবী মন্টু, নান্দা গ্রামের কেরামত আলী শেখ, খায়রুল আনাম (সাত্তার), বক্স সরদার, করম আলী, আবেদ আলী, আবুল কাশেম আজাদ, আব্দুল কুদ্দুস, কালু মিঞা, সেকেন্দার আলী, আছের উদ্দিন, আব্দুল গফুর, জয়নাল আবেদীন ও ছেরু প্রামানিক।
সেখানকার নিহত দু’জন পাকসেনাকে দাশুড়িয়া- নাটোর রোডের একটি স্থানে গাছের ডালে বেশ কয়েকদিন ঝুলিয়ে রাখে বিক্ষুব্ধ জনতা। ঈশ্বরদীর মাধপুর, দাশুড়িয়া ও মুলাডুলি’র সেসব যুদ্ধের অঘোষিত কমাণ্ডারের ভুমিকা পালন করেছিলেন সদ্য পাকিস্তান এয়ারফোর্স থেকে ছুটিতে আসা সেনাকর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম মন্টু যিনি পরে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর ঈশ্বরদী অঞ্চলে যুদ্ধরত ব্রেভো কোম্পানির কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকেঃ রেডিও আজ একচোটেই বলে দিয়েছে আটটা-পাঁচটা কারফিউ থাকবে না।সকালেই গেলাম গুলশানে রুমী-জামীকে বাড়ি নিয়ে আসতে। আজ রুমীর জন্মদিন, অন্তত দুপুরে কিছু রান্না করে খাইয়ে দিই। গিয়ে দেখি কিটি ওখানে বেড়াতে গেছে। গুলশানে বেশির ভাগ বাড়িতে বিদেশীদের বাস-সেখানে চলাফেরার একটু সুবিধে, আর্মির উৎপাতও একটু কম।ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, কাঁচাবাজার সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন, কিছুই পাওয়া যায় না-আজও কি ডাল আলু দিয়ে খাওয়া হবে? হঠাৎ চোখে পড়ল এয়ারপোর্ট রোডের সার সার বন্ধ দোকানের মাঝে ছোট্ট একটা গোশতের খোলা দোকানে মাত্র একটি খাসির রান ঝুলছে। তক্ষুণি গাড়ি থামিয়ে রানটা কিনে নিলাম। বললাম, “রুমী তোর কপালে পেয়ে গেলাম।”বাড়ি পৌছে দেখি চিংকু আর কায়সার বসে আছে। বললাম, “ভালোই হল তোমরা এসেছ। আজ রুমীর জন্মদিন। তোমরা দুপুরে ওর সঙ্গে খেয়ে যাও।”তারপর তিনটে চুলো ধরিয়ে কাসেম,বারেক দু’জনকে খাটিয়ে নিজেও দ্রুত খেটে তৈরি হল পোলাও, কোর্মা আর চানার হালুয়া। গুলশান থেকে আসার সময় রেবা তার বাগানের কিছু টম্যাটো তুলে দিয়েছিল। সেটা দিয়ে সালাদ বানানো হল।খাওয়ার পর ঢেকুর তুলে জামী বলল, “ভাইয়ার জন্মদিনের খাওয়াটা ভালোই হল। এমন দুর্দিঁনে এর বেশি আর কি চাই?”
খাওয়া-দাওয়ার পর রুমী জামীকে আবার গুলশানে রেখে এলাম।
বিকেল ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সমাবেশের কাজ সম্পন্ন হয়। ব্যাটালিয়নের অফিসার এবং সৈনিকদের টাউন হলে একত্র করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ।
পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে এসে মেডিক্যাল কলেজ ও নিকটবর্তী পাহাড়ের ওপর সমবেত হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানিরা প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়।
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর রাতে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে তাঁকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।
রাত ১১টায় জগদীশপুরের মহড়া থেকে প্রথম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যশোর ইউনিটে ফিরে আসে এবং গোলাবারুদ অস্ত্রাগারে ফেরত দেয়।
ক্যাপ্টেন রশীদের সফল অভিযানে ২৫তম পাঞ্জাবের মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইশফাকসহ ৪০ জন পাকিস্তানি সৈন্য পাবনা থেকে গোপালপুরের পথে নিহত হয়। জীবিতদের অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে রাজশাহীর দিকে যাওয়ার পথে প্রাণ হারায়।
রাতে ১০০ জনের মতো বাঙালি ইপিআর-কে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে রমনা কালীবাড়ির কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
সকালে ময়মনসিংহের রাবেয়া মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে ইপিআর বাহিনী ও হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
নির্ভীক সৈনিক সিপাহি লুৎফর রহমান লালমনিরহাট শহরের কাছে অবাঙালি ও বাঙালি ইপিআরদের সংঘর্ষে শহীদ হন।
ইপিআর সিপাহি আবদুল হালিম ১২ নম্বর উইংয়ের সুনামগঞ্জ কম্পানি হেডকোয়ার্টারসে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শহীদ হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা।
লেখকঃমোহাম্মদ হাসান,সাংবাদিক ও কলামিস্ট।