এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

আজ বিশ্ব জাগানো কালজয়ী ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর থেকেই স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। তখন জাতির জন্য দরকার ছিল একটি ঘোষণার, একটি আহ্বানের।

কবি নির্মলেন্দু গুণ দা”র ভাষায়—–
“একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: কখন আসবে কবি?”

অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এল সেই ঘোষণা। নেতার এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। মুক্তিকামী বাঙালি নেয় চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্খিত মুক্তির লক্ষ্যে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর দিনপঞ্জি মতে,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিকেলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) দশ লক্ষাধিক লোকের অভূতপূর্ব সমাবেশে ভাষণ দেন। ২৬ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”


বেলা সোয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো কোট পরিহিত শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও “জয়বাংলা’ শ্লোগানের মধ্যদিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আহবান জানালেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” তিনি ঘোষণা করেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।… আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”


বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল শ্লোগান, “জাগো জাগো- বাঙালি জাগো”, “পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা”, “তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো।”


ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারিরা কাজ বর্জন করেন এবং বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সকল অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রিলে করা হবে- এ ঘোষণার পর সারা বাংলায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। শেষ মুহূর্তে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে। তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুরনায় চালু হয়।

বীর মুক্তিযুদ্ধাগণের স্মৃতি চরনে জানতে পারি মুলত সেই ভাষণই বাঙালিকে পরিপূর্ণ প্রেরণা জুগিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনতে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছিলো।তবে এটাও সত্যি যে সেই বাঙালি আবার ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর বহু বছর চাইলেও সেই ভাষণ শুনতে পারেনি! বাজাতে পারেনি! বা বাজাতে-শুনতে দেয়া হয়নি!


কবি গুণ দা”র কবিতায় উঠে এসেছে———–
“জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷

অবশেষে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জাতির পিতার কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় এলে ঐ ভাষণই আন্তর্জাতিক ইতিহাসের প্রামান্য দলিলের স্বীকৃতি পায়।

জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন “বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের”(বিএনসিইউ) ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাষণটির স্বীকৃতি মেলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৭ মার্চের ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত ফাইলের সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেন ওই বছরের ৩০ মার্চ। এরপর শুরু হয় পরবর্তী কার্যক্রম। এসময় ইউনেস্কোর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, মর্মার্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরা হতে থাকে। এর অংশ হিসেবে ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত এক কর্মশালায় ভাষণটির ওপর একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বিএনসিইউয়ের তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার ও শিক্ষাবিদ রোকেয়া খাতুন।

“সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো, মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের”বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে ওই কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। একটি জাদুকরী ভাষণ কীভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে ওই প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণের ওপর তৈরি প্রেজেনটেশনটি ব্যাপক প্রশংসা পায়। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম ইউনেস্কোতে ভাষণটির বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন দাখিল করেন। আবেদন দাখিলের পর সেটি যায় এ সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটিতে। ২৪-২৭ অক্টোবর ওই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সব প্রক্রিয়ার সম্পন্ন শেষে আসে কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা।

সাধারণত আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে, এমন বিষয়গুলোকেই বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে (মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) তালিকাভুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের এ ভাষণটিকে অনুবাদ করা হয়েছে বহু ভাষায়। নিউজউইক সাময়িকী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে “রাজনীতির কবি” হিসেবে অভিহিত করে।

প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির আগেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিকভাবে একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ২২৩ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। “উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস- দ্য স্পিপচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি” নামের ওই গ্রন্থ সংকলন করেছেন জ্যাকব এফ ফিল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ দিয়ে শুরু করা সংকলনের শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায়”‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স” শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি।

তবে ইহাই সত্য, ইহাই বাস্তব যে সেই ৭ মার্চের ভাষণ;
শুধুমাত্র অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালী মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক সমরসজ্জিত, প্রশিতি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালী একাত্তরের মাত্র ন’ মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাস্ত-পর্যুদস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, দুঃসাহসিকতা আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালী অর্জন করে নিজস্ব মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা। তথ্য সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ইউনেস্কো স্বীকৃতি নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored