ক্র্যাকপ্লাটুনের শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মতো তারছিঁড়া বা ক্র্যাকপিপল কনভেনশনাল আর্মিতে সচরাচর দেখা যায় না। কেননা আর্মি মানেই শৃঙ্খলা, কঠোর নিয়মের বেড়াজাল। একাত্তরে পাকিস্তানী আর্মি থেকে বিদ্রোহ করে আসা বাঙ্গালী অফিসাররা সাধারণ গণযোদ্ধাদের নিয়ে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন, সেটাও কঠোর শৃঙ্খলা আর সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ছিল কয়েকজন বিচিত্র তারছিঁড়া, তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা দুর্ধর্ষ পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে যেখানে বুক কাঁপাটাই ছিল স্বাভাবিক, সেখানে এই মানুষগুলা ছিল পুরো উল্টো। পাকিস্তানীরা ছিল এদের কাছে শিকারের বস্তু। ভয় পাওয়া তো দূরে থাক, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার সময় তাদের চোখ চকচক করতো শিকারের আনন্দে!
একাত্তরের জুন মাস। গেরিলাদের ট্রেনিং প্রায় শেষ দিকে। এক সকালে মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে হুট করে দারোগাবাগিচায় হাজির হলো রুমি। মেজর ডাক্তার আখতারের নেতৃত্বে দুই নম্বর সেক্টরের ফিল্ড হাসপাতাল তখন স্থানান্তর হয়েছে দারোগাবাগিচায়। রুমির খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন আখতার, সারাদিন বহু হইচই হলো। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই রুমি প্রস্তাব দিল, চলেন আখতার ভাই, কিছু পাইক্কা মাইরা আসি! যেকোনো বিচারেই প্রস্তাবটা বিচিত্র রকমের ভয়ংকর, সে সময়ে যে কেউই প্রস্তাবটা শুনে অদ্ভুত অবিশ্বাসের চোখে তাকাবে, কিন্তু কি আশ্চর্য, সবাই হৈ হৈ করে তাতে সম্মতি দিল। রুমিটা যেমন ক্র্যাক, তার চেয়েও বেশি ক্র্যাক তার সাথেরগুলা। দেখো দেখি কান্ড!
ঠিক হলো মেজর আখতার, রুমি, বাহার, জামাল, তাহের আর অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার জাহেদ আলী যাবে। হুট করে শামসুদ্দিনও গোঁ ধরে বসলো, তাকেও নিতে হবে। আরে কি মুশকিল, কোনোদিন গুলির সামনাসামনি হয়নি, সরাসরি যুদ্ধ দেখেনি, মোটা ফ্রেমের চশমার শান্তশিষ্ট পড়ুয়া ছেলে হিসেবেই পরিচিতি তার, সে কীভাবে যুদ্ধে যাবে? কিন্তু তার এক জেদ। অগত্যা কি আর করা, রাজি হলেন আখতার। তবে একটা শর্তে, যা বলবেন, সেইটাই মানতে হবে। ততক্ষনে যুদ্ধে যাবার অনুমতি পেয়ে আকাশে উড়ছে ছেলেটা, শর্ত শোনার সময় কই?
রাত এগারোটায় বেরোল ওরা। দুইটা করে চাইনিজ এসএমজি আর ইন্ডিয়ান এসএমজি আর একটা চাইনিজ রাইফেল সম্বল। নিশুতি রাত, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকলো ওরা। অনেকক্ষণ হাঁটার পর দূরে একটা আলো দেখা গেল। একটা বড়সড় বেড়ার ঘর, ভিতরে আলো জ্বলছে। তাহেরকে পাঠানো হলো রেকি করতে, জানা গেল অনেকগুলো লোক ভেতরে জুয়া খেলছে। স্মাগলার হবে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাদের যোগসাজশ না থাকলে এই সময় এই জায়গায় বসে জুয়া খেলার প্রশ্নই ওঠে না। আখতার বললেন, ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।
ক্রল করে গিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে দরজায় লাত্থি মেরে হ্যান্ডস আপ বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল সবাই, সাথে সাথে যেন ঘরটায় টর্নেডো বয়ে গেল। শার্ট, চাদর, টাকাপয়সা যা যেখানে ছিল, সেখানে সেভাবেই পড়ে রইল, হুটপাট করে বেড়া ভেঙ্গে এতগুলো মানুষ সব হাওয়া, একেবারে যেন ভোজবাজি। পাকিস্তানী মারতে এসে এহেন সার্কাস দেখে সবার তো হাসতে হাসতে দমবন্ধ হবার যোগাড়।
ফিরে এল সবাই, একটু পর নামলো ঝর ঝর বর্ষার বৃষ্টি। কিন্তু মনের ভেতর খচখচানিটা বাড়তেই লাগলো। পাকি যে মারা হলো না। সবাই যেন সবার মনের কথা পড়তে পারলো। তাই ভোর চারটার দিকে দেখা গেল, সবাই আবার বৃষ্টি মাথায় বের হয়েছে, কয়েকটা পাকি মেরে না আসলে চলছেই না!
এবার একটু বর্ডার ঘেঁষে বিবির বাজারের কাছাকাছি বাংকারগুলোর দিকে এগোল ওরা। নদীর ওপাড়ে সারিসারি পাকিস্তানী বাংকার, ভোর হচ্ছে মাত্র। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা রাস্তায়, আবছা দেখা যাচ্ছে বাংকারগুলো। নদীর পশ্চিম বাঁকের মুখে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল রুমি, বাহার আর জাহেদ আলী। বাকিরা নদীর বাঁক ঘুরে পরের আরেকটা বাংকারের সামনে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে আলো ফুটলো, অপেক্ষা চলছে কেউ বাংকার থেকে বের হয় কিনা।
কয়েকজন পাকিকে বাংকারের বাইরে হাতের মুঠোয় পাবার আশায় থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে বুঝতে পারা গেল, এই ঝিরঝির বৃষ্টির আরামে মজাসে ঘুমাচ্ছে শালারা, একসাথে অনেকগুলোকে হয়তো পাওয়া যাবে না। অগত্যা আখতার সবাইকে ডেকে জানালেন,
“শালারা তো সব আরাম কইরা ঘুমাইতেছে, অনেকগুলারে পাওয়া যাইব না। এর চাইতে যার সামনে দুজনের বেশি পাকিস্তানী পাওয়া যাইব, তারাই আগে ফায়ার ওপেন করো, বাকিরা সেই অবস্থায়ই জয়েন করবা, ঠিক আছে?”
অনেকক্ষন পর অবশেষে সকাল সাতটার দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরলে দুইজন পাকিরে দেখা গেল আলুথালু বেশে বের হচ্ছে, শার্টটা ঝুলতেছে প্যান্টের উপর। পেছন পেছন আরেকটা হায়েনার মতো হাসতে হাসতে উর্দুতে কি বলতে বলতে বের হলো, প্যান্টের বেল্ট খোলা, শার্টে অসংখ্য ভাঁজ, বোঝাই যাচ্ছে, মাত্র পাশবিকতার লোলুপ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেছে হায়েনাটা। একটা গেল নিচে প্রস্রাব করতে, আরেকটা বাংকারের সামনে দাঁড়ায়ে ওই পাকি সেনার সাথে খোশগল্পে মত্ত হয়ে গেল। আখতার রুমিকে সংকেত দেবার জন্য মাত্র মুখ খুলেছেন, সেই মুহূর্তে হঠাৎ রুমির গান থেকে শুরু হলো অটোমেটিক ফায়ার। পাকিটার হাসি শেষ হলো না, তার আগেই চলে গেল নরকের নিকৃষ্ট তলদেশে। আরেকটা বোধহয় কোন নোংরা রসিকতা করতে মুখ খুলেছিল, মুখ আর বন্ধ হলো না। তিনটার মধ্যে দুটাই মরল উইথ দেয়ার প্যান্টস ডাউন।
প্রাথমিক তিনটা টার্গেটরে নরকে পাঠায়ে বাংকার দুটোর ফুটো দিয়ে দু’দফা ব্রাশফায়ার করে দুটো গ্রেনেড ফেলে দেয়া হলো। তার আগেই অবশ্য নির্যাতিতা মেয়ে দুজনকে বের করে আনা হয়েছিল। পাঁচ মিনিট পরেই উইথড্র করার নির্দেশ দিলেন আখতার, ফায়ারের আওয়াজ পেয়েছে পাকি ছাগলগুলা, এক্ষুনি ওরা মর্টার দাগবে।
হাসপাতালে ফিরতে ফিরতে বাজলো সকাল নয়টা। মেলাঘরে গিয়ে আখতার অভিযানের রিপোর্ট করলেন দুপুরে, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র এবং দুই নম্বর সিচুয়েশন রিপোর্টে খবরটা সম্প্রচারিত হয়ে গেল সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে। ঘটনা শুনে তো দুই নম্বরের সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কটমটে চেহারায় চেয়ে রইলেন, না পারেন বকতে, না পারেন সইতে। আজিব সব পাবলিক, পুরাই তারছিঁড়া।
পাইক্কাগুলার নাস্তানাবুদের খবর শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার দশা সবার, মেজর নুরুল ইসলাম শিশু সেদিন সেক্টরে ছিলেন,হাসতে হাসতে আখতারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তোমাগোর জানে কোন ভয় নাই? পাগলামির তো একটা লিমিট আছে মিয়া, এইসব কি করো তোমরা?”
আখতার মাথা চুলকে জবাব দেন, “ইয়ে মানে স্যার, বসে থাকতে থাকতে হাত পায়ে জং ধইরা গেছিল তো… এই একটু ব্যায়াম কইরা আসলাম আর কি…!“
এই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ, এই ছিল আমাদের অসামান্য জন্মইতিহাস। পিশাচের জিব টেনে ছিঁড়ে আনতে পারতো বদি-জুয়েল, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জয় বাঙলা বইলা চিৎকার করার হ্যাডম ছিল রুমি-আলতাফ মাহমুদদের। এঁদের আমরা ক‘জন চিনি? পাকিস্তানীদের কেন ঘৃণা করতে হবে, কেন অতীত ভুলে পাকিস্তানীদের সাথে মিলেমিশে এগোনো যাবে না ইত্যাদি চিন্তাভাবনায় বুঁদ প্রজন্মের আমরা ক‘জন জানি যে ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধষ গেরিলা শাফী ইমাম রুমী‘র লাশটাও খুজে পাওয়া যায়নি? কল্পনার অতীত নির্মমতম উপায়ে অত্যাচার চালিয়েছিল তার উপর পাকিস্তানীরা? জানার চেষ্টা করেছি একবারও?
বোধহয় না। কার সময় আছে এতো পুরনো ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করার, তাই না?
আজ রুমীর জন্মদিন। শুভ জন্মতিথি বঙ্গশার্দুল!
গ্রন্থ কৃতজ্ঞতা- ১। বারে বারে ফিরে যাই/মেজর ডাঃ আখতার(অবঃ) বীর প্রতীক,
২। একাত্তরের দিনগুলি/জাহানারা ইমাম।