বাঙালির স্বাধীন সত্বার বিকাশ আটকে দেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৪ সালে বিডি ভোটে আইয়ুবখান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি থেকে ১৯৬৪ সালে মৌলিকগণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়া পর্যন্ত সবই ছিল একটা গভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের নীলনক্শার ধারাবাহিকতা।আইয়ুবের পাচাটা গভর্ণর মোনায়েম খান মনে করেছিল রবীন্দ্রনাথকে বিদায় করতে পারলেই বাঙালির প্রাণের সুরে আর বাশি বাজবে না। বাশ না থাকলে বাঁশিও থাকবে না।
রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জন করা হ’ল। ছাত্রদের বইপত্র থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হ’ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসার আব্দুল হাইকে ডেকে মূর্খ বটতলার উকিল মোনেম খান ধমক দিয়ে বললো, আপনারা কেন নিজেরাই রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতে পারেননা। কেন আপনারা একজন হিন্দু কবিকে দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত লেখান? সেই দুঃখে অপমানে কিনা জানিনা সে সময় অধ্যাপক আব্দুল হাই সকাল বেলায় ভ্রমনে বেরিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। রবীন্দ্রভক্তদের উপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে এসেছিল। ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছিল। ভাষা সৈনিক সাংবাদিক রনেশ দাশ গুপ্তসহ অনেক রবীন্দ্র প্রেমিক গ্রেফতার হলেন। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া, সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরি সহ প্রগতিশীল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা রুখে দাড়ালেন। এ সময় জনমত বিগড়ে যেতে দেখে সরকার তাদের দালাল বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিকদের মাঠে নামালো । তারা রবীন্দ্র বর্জনের পক্ষ্যে হুক্কহুয়া শুরু করলো। সে সময় সরকারের মগজ ধোলাই কারখানা ‘এনবি আর’(বুরো অফ ন্যাশনাল রি কনস্ট্রাকশান) এর মাসোয়ারা খাওয়া ৪০ জন কবি সাহিত্যিক বিবৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ঝেটিয়ে বিদায় করে পাঠ্যপুস্তক পাক সাফ করার ও রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত হারাম করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাদেরকে ৪০ চোর খেতাব দেয়া হয়েছিল জনগনের পক্ষ্য থেকে।তাদের নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়। তবু নামগুলো জেনে রাখা দরকার। কারণ তাদের প্রেতাত্মারা এখনও সরব হয় ইমাজুদ্দিন আহমদ, আসীফ নজরুল , গোলাম মাওলা রণি প্রভৃতি ‘গুনিজনের’ ঘাড়ে সওয়ার হয়ে।রবীন্দ্রবর্জনের পক্ষ্যে বিবৃতিদানকারী ৪০ চোর নামে খ্যাত সেই বুদ্ধিজীবীরা হলেন:১.মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ,২.বিচারপতি আব্দুল মওদুদ,৩.আবুল মনসুর আহমদ, ৪.আবুল কালাম শামসুদ্দিন,৫.অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ,৬.মুজিবুর রহমান খাঁ,৭.মোহাম্মেদ মোদাব্বের,৮.কবি আহসান হাবিব, ৯.বেনজির আহমদ,১০. কবি মইনুদ্দিন,১১. অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দিন, ১২.আ কা ম আদমউদ্দিন,১৩.তালিম হোসেন, ১৪.শাহেদ আলী,১৫. আ ন ম বজলুর রশিদ, ১৬.মোম্মদ মাহফুজুল্হলাহ, ১৭.সানাউল্লাহ নূরী, ১৮.কবি আব্দুস সাত্তার,১৯. শিল্পি কাজী আবুল কাশেম,২০. মুফাখকারুল ইসলাম,২১. শামসুল হক, ২২.ওসমান গনি, ২৩.মফিজউদ্দিন আহমদ,২৪. আনিসুল হক চৌধুরি, ২৫.মোস্তফা কামাল, ২৬.অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান,২৭.জহুরুল হক,২৮. ফারুখ আহমদ,২৯. শামসুদ্দিন আহমদ, ৩০.বেগম হোসনে আরা, ৩১.মাহরুফা চৌধুরি, ৩২.নাসির আলি,৩৩. এম নুরুল ইসলাম, ৩৪. জাহানারা আরজু, ৩৫. কাজী আব্দুল ওয়াদুদ ৩৬.আখতারুল আলমসহ আরও ৪জন।
সেই চল্লিশ ঘৃণ্য বুদ্ধিজীবীকে ৪০চোর উপাধি দিয়েছিলেন কবি আবদুল গনি হাজারি। এরা বিখ্যাত রাজাকার অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনের দোসর। তারা প্রায় সবাই অনতি প্রচ্ছন্নভাবে একাত্তরে রাজাকার ভুমিকা পালন করেছিলেন। আলবদর কর্তৃক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেন্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকান্ডেও এরা নৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিলেন এবং সেই হতভাগ্য শহীদদের তালিকা প্রণয়নে সহায়তা করেছিলেন। এমন অভিযোগ রয়েছে। উত্তরকালে এদের অনেকে ভেড়ার চামড়া পরে নিরীহ সেজেছিলেন। অনেকে আবার বহুমূল্যে কলঙ্ক মোচনেরও প্রয়াস রেখেছিলেন।জাতির ঘৃণা এদের অনন্তকাল দহন করবে।