সেদিন রোববার, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। দোলাইরখাল এলাকা সংলগ্ন রোকনপুরের ১২ নম্বর বাড়িতে, সপরিবারে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ। ঠিক সে সময়েই আল-বদরের জল্লাদ চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আজ পাঁচ দশকেও জানা যায়নি তাঁর কোন সন্ধান
১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর, একাত্তরে পিতা হারাবার যন্ত্রণা নিয়ে বড় হওয়া শারমিন রীমার সাথে বিয়ে হয়, তৎকালীন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল এবং বিএমএর সাবেক সভাপতি ডা. আবুল কাশেম এবং ডা. মেহেরুন্নেসার ছেলে মুনীর হোসেন সুরুজের সঙ্গে।
বিয়ের মাত্র ১১৮ দিনের মাথায় ৮ এপ্রিল ১৯৮৯, দিবাগত রাতে (দিনপঞ্জীতে ৯ এপ্রিল) অত্যন্ত নৃশংসভাবে শারমিন রীমা’কে হত্যা করে মুনির হোসেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করা মুনীর হোসেন প্রমাণ করেছে, ‘শিক্ষা আদতে মনুষ্যত্বের নিশ্চয়তা দেয়না’।
১৯৮৯ সালে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত হত্যাকাণ্ড। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে মুনীর জানিয়েছিল, ‘সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে চিটাগাং থেকে ঢাকার পথে রওনা হই। আসার পথে আমি রীমাকে খুন করার কথা চিন্তা করি। আমি রীমাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার চান্স খুঁজছিলাম। তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে আমি চান্স পাই। মুক্তি সরণির কাছে বিশ্বরোডে মিজমিজি গ্রামে যাওয়ার কাঁচা রাস্তার মোড়ে (মৌচাক সরণি) আমার গাড়ি থামিয়ে ফেলি।
তখন রাত সোয়া ২টা বাজে। আমি গাড়ির স্টাট বন্ধ করি। গাড়িতে বোতল দিয়ে রীমার ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করি। তখন সে একটু অচেতন অবস্থায় ছিল। তখন আমি তাকে চুলে ধরে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের কাছ থেকে বের করি।
আমি তাকে কয়েকবার মাটিতে ফেলে বোতল দিয়ে আঘাত করি। তারপর আমার গাড়িতে থাকা ছুরি দিয়ে তাকে পেটে আঘাত করি। ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করি। এর পাশে একটা খাল ছিল। আমি তাকে ওই খালে ফেলে দেই। এরপর আমি পাগলের অভিনয় করি।’
পুলিশের তদন্তে জানা যায়,
“শারমিন রীমার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর মুনীর গাড়ি স্টার্ট দেয়। একটু দূরে ডোবায় গিয়ে নিজের পরনের প্যান্ট এবং রক্তাক্ত জামা ছুড়ে ফেলে ডোবায়। হাতে থাকা ছুরিটা ছুড়ে মারে আরেকটু দূরে। গাড়ি নিয়ে আগায় যাত্রাবাড়ির দিকে। নিজের গাড়িটি ফেলে রেখে যায় সায়েদাবাদের বাস টার্মিনালের উল্টো দিকে। গাড়িটি তালাবদ্ধ করে রাখে সে।
রক্ত মাখা সব জামা ফেলে দিলেও একটি গেঞ্জি রয়ে যায় গাড়ির ভেতর। আর গাড়ির গায়ে রয়ে যায় রক্তের কিছু চিহ্ন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গাড়িটি যখন পুলিশের হাতে আসে তখন পুলিশের কাছে বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
মুনীর গিয়ে আশ্রয় নেয় হোটেল বদরে। সেখানে সে বিশ্রামের জন্য গেলে হোটেলের দারোয়ান আলী হোসেন তাকে ২০৩ নাম্বার রুমে নিয়ে যায়। ডাঃ মেহেরুন্নেসার ছেলে পরিচয় পাবার পর আলী হোসেন তাকে জিজ্ঞেস করে বাসা ছেড়ে সে হোটেলে কেন এসে উঠল। মুনীর তার স্ত্রীকে হত্যার কথা বলায় কিছুটা ভয় পেয়েই হয়তো আলী হোসেন চলে যায়।
এরমাঝে হোটেল কক্ষে সে আত্মহত্যা করার জন্য বিছানার চাদর গলায় বেঁধে উপরে ফ্যানের সাথে ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করলে পাশের রুমের লোকেরা তালা ভেঙে ভেতরে এসে তাকে উদ্ধার করে এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে তার মায়ের সাথে ফোনে আলাপ করে এবং একজন আইনজীবী নিয়ে হাসপাতালে আসতে বলে। এর মধ্যে পুলিশ তার খোঁজ পেয়ে যায়, তাকে গ্রেফতার করে।”
১৯৯০ সালের ২১ মে, তৎকালীন সময়ের আলোচিত হত্যাকাণ্ডের রায়ে মূল আসামী মুনীর হোসেন সুরুজ এবং হোসনে আরা খুকুর ফাঁসি ঘোষণা করা হয়।
এরপর একাধিক আইনি লড়াই শেষে উচ্চ আদালত মুনীরের ফাঁসির রায় বহাল রেখে খুকু’কে রেয়াত দেন। ১৯৯৩ সালের ২০ জুন, আপিল বিভাগ ওই দণ্ড বহাল রাখেন।
শারমিন রীমা হত্যাকান্ডের চার বছর তিন মাস পর ১৯৯৩ সালের ২৭ জুলাই একমাত্র আসামী মুনীর হোসেন সুরুজের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে একটি বিচার সম্পন্ন হবার মাইলফলক স্পর্শ করেছিল বাংলাদেশ।
আজ, শহীদ নিজামউদ্দিন আহমদের কন্যা শারমিন রীমার ৩২ তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা তাঁর চিরশান্তি প্রার্থনা করছি।
অনুলিখনঃ- শমিত জামান সাংবাদিক কলামিস্ট।