বাংলাদেশে বাম-স্যাকুলার এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

বাংলাদেশের বাম-স্যাকুলারদের রাজনীতি সর্বদাই অন্যদের ছত্রছায়ায় চলেছে। ১৯৪৭-এর পূর্বে তারা ছিলো কংগ্রেসের ছত্রছায়ায়, পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিমলীগের ছত্রছায়ায়, একাত্তরের পটভূমিতে ভারতের ছত্রছায়ায় মস্কোপন্থীরা আর পাকিস্তান সরকারের ছত্রছায়ায় চীনপন্থীরা, একাত্তরের পর তারা বঙ্গবন্ধুর ছত্রছায়ায় চলে আসেন, দীর্ঘদিন তারা আওয়ামীলীগের ছায়াসংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

স্বৈরাচারী সামরিক শাসক আয়ূব খানের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের উলামায়ে কেরামগণ আন্দোলন শুরু করলে বাম-স্যাকুলারদের একটা অংশ আয়ূব খানের সাথে দীর্ঘদিন সহযোগী হয়েছিলেন। আর বাকি অংশ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ছত্রছায়ায় এসে যান। উলামায়ে কেরাম আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে গেলে বামরা মাওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে ময়দান দখল করে নিলেন। কিন্তু যেহেতু মাওলানা ভাসানী স্যাকুলার কিংবা বাম ছিলেন না তাই ওরা সুবিধা করতে পারেননি। বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে বামরা কোনোদিন স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেননি। তারা একেক সময় একেক জনের লেজুড় বৃত্তিতা করে বক্তৃতা-বিবৃতিতে ব্যক্তিগত নেতা হয়েছেন। অবশ্য প্রচারে-সাহিত্যে তাদের অবস্থান খুব দৃঢ় ছিলো।

বাংলাদেশের বামরা স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছত্রছায়ায় এসে নিজেরা সাময়িক উপকৃত হলেও বঙ্গবন্ধু কোনোদিনই বাম কিংবা স্যাকুলার ছিলেন না। তাকে বাম এবং স্যাকুলার হিসেবে চিহ্নিত করতে বাংলাদেশে দু’টি গ্রুপের চক্রান্ত খুব জঘন্য রকমের। এক. বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুকে বাম হিসেবে পরিচিত করতে খুব চেষ্টা করেছেন-বটবৃক্ষকে নিজেদের পক্ষে দেখানোর জন্য। নিজেদের তো কিছু করার সাধ্য নেই, তাই যিনি করে সফল হয়েছেন তাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারলে খুব ভালো হয়-তাই এই চেষ্টা। দুই. পাকিস্তান সরকার এবং তার সহচর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের লোকেরা এ কাজটা খুব শক্তভাবেই করেছেন।

কারণ শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারলে সাধারণ মানুষ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসে যাবে না। স্বাধীনতার পর সাধারণ মানুষ যখন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদেরকে ধিক্কার দিতে শুরু করলো তখন আত্মরক্ষার্থে তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামের শত্রু হিসেবে প্রচার করতে লাগলেন। একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের প্রধান নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম সাহেবসহ বাকিদের কাছে প্রশ্ন-আপনাদের তৎকালীন নেতা মদ্যপ ইয়াহিয়া এবং স্যাকুলার ভূট্টো থেকে কি উন্নত চরিত্রের অধিকারী শেখ মুজিব ছিলেন না? একটু নিরপেক্ষ এবং ঈমানদারীর সাথে বিবেচনা করে উত্তর দিন। শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রে বাম কিংবা স্যাকুলারিজম আপনারা কোথায় দেখলেন? ইয়াহিয়া-ভূট্টো শুধু চরিত্রহীন স্যাকুলার নয়, নিয়মতান্ত্রিক মদ্যপও ছিলেন।

জুলফিকার আলী ভূট্টো তো ঐ ব্যক্তি যিনি বিশ্বাস করতেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এক বক্তব্যে তিনি এ ঘোষণা দিলেন-পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম ভূট্টো সাহেবকে কাফের ফতোয়াও দিয়েছিলেন। পাকিস্তান জামাতে ইসলামির বড় নেতা ‘মাওলানা কাওসার নিয়াজী’ এই ফতোয়ার সমর্থনে একটি বইও তখন প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিটি মসজিদের জুম্মায় ভূট্টোকে কাফের ফতোয়া দিয়ে খতীবরা বক্তব্য রেখেছেন এবং একদিন কালো দিবসও পালিত হয়েছে। (নিউ ওয়ার্ল্ডওভার, ইসলাম আউর পাকিস্তান, অক্টোবর ১৯৯৮, পাকিস্তান-এ গ্রন্থের লেখক ভূট্টো সাহেবের দল পাকিস্তান পিপলস পার্র্র্র্র্টির নেতা তারেক ওয়াহীদ বাট)।

শেখ মুজিবুর রহমান এতো জঘন্য কথা কোনোদিন মুখে উচ্চারণ করেছেন বলে আমরা ইতিহাসে পাই না। জুলফিকার আলী ভূট্টোই তো প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান ভাঙার জন্য প্রধান দায়ী। ১৯৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিজয় হলে ভূট্টো সাহেব ঘোষণা করলেন-‘উধর তুম ইধর হাম’ অর্থাৎ ওখানে তুমি এখানে আমি। অতঃপর ঘোষণা দিলেন-‘যে পূর্ব-পাকিস্তানে এসম্বলিতে যাবে সে আর পশ্চিম-পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে না, যদি আসে তবে তার পা ভেঙে দেওয়া হবে’।-(প্রাগুক্ত) তাহলে পাকিস্তান ভাঙার জন্য গাদ্দার শেখ মুজিব, না ভূট্টো সাহেব এবং আপনারা কোন যুক্তিতে ইয়াহিয়া-ভূট্টোর পক্ষ নিলেন? ৭১-এর স্বাধীনতাপূর্ব শেখ মুজিবের ছাত্র রাজনীতি কিংবা জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে স্যাকুলারিজম পেলেন কোথায়?

শেখ মুজিবের রাজনীতি শুরু হয়েছিলো মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগিশ প্রমুখদের চিন্তা-চেতনায় পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে। মাওলানা আতহার আলী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো যে, শেখ সাহেব তাঁকে দাদা ডাকতেন। আর মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর সংস্পর্শে তাঁর যাওয়া-আসা হতো প্রায়ই। তারা দুজন একই এলাকার লোক। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী সেই সময়ে যেমন বড় আলেম ছিলেম তেমনি বিএ পাশ ছিলেন, ফলে স্কুল-মাদ্রাসার সকল শিক্ষিতের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। সে যাই হোক, শেখ সাহেব তো কোনোদিনই বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবস্থানটা যখন বটবৃক্ষের মতো হয়ে গেলো তখন বামরা দল বেঁধে তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকতেই তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন, ড. কামাল হোসেন প্রমুখদের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু শেখ সাহেব জেল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফেরার পর একদিন তাজ উদ্দিনকে ধমক দিয়ে বললেন-‘তাজ উদ্দিন ঐ বেটি (ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী) যা বলেছে তুই চোখ বুজে মেনে নিলি, কী লিখেছে তা দেখে কি দস্তখত করেছিস? জিজ্ঞেসও করিস নাই কিসে দস্তখত দিচ্ছিস?’ (গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাক্ষাৎকার, ইকরা-দ্বিতীয় সংখ্যা, মার্চ ২০০১, বার্মিংহাম, ইউকে)।

পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্মসম্পাদক এবং ‘বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক বাংলাদেশ প্রতিনিধি, গিয়াস কামাল চৌধুরীর মতে-‘বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে গোলাম-মুনিবের ন্যায় চুক্তির ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিলেন বলেই শেষ পর্যন্ত ভারতের সাথে বাণিজ্য চুক্তি অগ্রসর হতে দেননি। ১৯৭৪ ইংরেজিতে ইন্ধিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরকেও বঙ্গবন্ধু সুনজরে দেখেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমরা কোন ফাঁদে পা দিয়েছি’। শেখ মুজিবুর রহমান স্যাকুলার এবং ভারতের দালাল না হওয়ার পক্ষে গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্বাক্ষী এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু সাংবাদিক হিসেবে তিনি খুব কাছ থেকে শেখ সাহেবকে শুধু দেখেননি বরং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মল সেন, আতাউস সামাদ এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত সাংবাদিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

শেখ সাহেব যে ইসলামদ্রোহী স্যাকুলার ছিলেন না তার বড় প্রমাণ-একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা এতো অপকর্ম করার পরও তিনি শুধু ইসলাম এবং উলামায়ে কেরামদের শ্রদ্ধার্থে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। খুলে দিয়েছিলেন বাম মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া সকল মাদ্রাসা, মসজিদ এবং ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored