বেশির ভাগ আলেম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ছিলেন

সাম্প্রতিক সংবাদ
তানভীর হাসান
Sponsored

১৯৬৪ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে এক সমাবেশে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।
পাকিস্তান কা মতলব কিয়া হ্যায়? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো,আল্লাহর কালিমা উঁচু করা) ১৯৪৭ সালে এই শ্লোগান শুনিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন, তখন সাধারণ ধর্মপ্রান হক্কানি আলেম-ওলামা জান বাজি রেখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাঙ্গালীদের উপর পাকিসেনাদের হত্যাজ্ঞ ও বর্বরতা দেখে বুঝতে পারলেন যে মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্নের বিভোর হয়ে আলেমরা যার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সেই জালেমদের মাধ্যমে তা কখনোই প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর আল্লাহর কালেমা জিন্দা করার সেই মধুর শ্লোগান নিছক চাপাবাজী বৈ কিছুই ছিলো না।
তখন জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের তথাকথিত কিছু নামধারী কিছু আলেম ছাড়া আলেমদের এক বিরাট অংশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে যোগ দেয়। জালেম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেন আলেম সম্প্রদায়।
জনপ্রিয় লেখক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে ১৩ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের কোন বন্ধু ছিলো না। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল একদল দেশদ্রোহী। তারা ছিলো কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দিন,জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম প্রমূখ। পাকিস্তানিদের সাহায্যের জন্য দেশদ্রোহীদের নিয়ে যে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিলো সেটি ছিলো জামায়াতে ইসলামীরই সশস্ত্র দল। হানাদার বাহিনীর পদলেহী হিসেবে এরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর যে জুলুম ও অত্যাচার করেছে তার অন্য কোনো নজির ইতিহাসে নেই।
মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভুমিকা প্রসঙ্গে তারেক মুহাম্মদ তওফিকুর রহমান তাঁর বিশ্লেষণে একটা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সেই সময় ইসলামপন্হী দল বা সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের ঝোক বা অনুসৃত ধারা অনুসারে ভাগ করেছেন। তিনি তার বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভুমিকা ও প্রভাব গ্রন্থের ২২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সেই সময়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা ছয় ভাগে বিভক্ত ছিলেন।
১/ বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম।
২/বিভিন্ন সাধারণ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম।
৩/ সরকারি /আধাসরকারী মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম।
৪/ কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম।
৫/ বিভিন্ন খানকাহ, সিলসিলাহ ও পীর মুরিদী সংশ্লিষ্ট আলেম।
৬/ ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ব্যক্তি পর্যায়ের আলেম।
এ ধারা গুলোর মধ্যে ইসলামপন্থী দলে জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের বাইরে আলেম সমাজের এক বিরাট অংশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয় অবস্থান নেন। এদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গনে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।
সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম মুহাম্মাদিল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান নেন। মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী তাঁর আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কি করবেন এ ব্যাপারে দেশ বরেণ্য আলেম মাওলানা হাফেজ্জী হুজুরকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীদের প্রতি অত্যাচার করেছে,সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কিভাবে? এটা তো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ প্রতিরোধ।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সেক্রেটারি মুফতি মাহমুদ সবসময় বাঙ্গালি মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন। ২৬ মার্চের আগে তিনি ঢাকায় এসে এ অংশের নেতাদের বলে দিয়েছিলেন, আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন, দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন। মাওলানা কাজি মহতাসিম বিল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সে সময় আমার দায়িত্ব ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্হা করা ও যুবকদের যুদ্ধে উৎসাহিত করা।
তাছাড়া মাওলানা আব্দুল্লাহ বীন সাঈদ জালালাবাদী,মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা দানেশ, মাওলানা আতাউর রহমান খাঁন, মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা মহিউদ্দিন খাঁন, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ প্রমূখ বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেটের অধিকারী। পাক হানাদার বাহিনী এসে কালিমা জিজ্ঞেস করতো। বলতে পারলে বুঝতো তারা মুসলমান, আর না পারলে হিন্দু প্রমাণিত হতো। এ ক্ষেত্রে অনেক আলেম নিজেদের ঘরে এসব হিন্দুদের আশ্রয় দিয়ে তাদের কালিমা শিখিয়েছেন এবং পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন।
২৫ শে মার্চের পর সেই সময়ের বড়ো মাদ্রাসা গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো। এতো কিছুর পরও কি কেউ বলবেন আলেম সমাজ স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন? স্বাধীনতার শত্রু ছিলেন? আসল সত্য হলো হক্কানি আলেম সমাজ স্বাধীনতার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু ছিলেন। আলেম ওলামা স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তবে হ্যা,অল্প সংখ্যক আলেম ছিলেন নীরব। তার কারণ বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই স্বাভাবিক কারণেই তারা পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার কথা হয়তো তখনও ভাবতে পারেনি। দ্বিতীয়ত ভারতবেষ্টিত এই ছোট্ট ভুখন্ডটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতটা ভারতীয় আগ্রাসনমুক্ত থাকতে পারবে,সে বিষয়ে একটা বিরাট সংশয় দেখা দিয়েছিলো তাদের মনে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর মতো নির্লজ্জ ভাবে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটপাট, হত্যা-ধর্ষণে কোন আলেম কখনো অংশ দেয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা পাক হানাদার পদলেহন করেছে, নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা অপরাধী,তারা ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্যই তারা কঠিন সাজার যোগ্য।
পরিশেষে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলছি, বাঙ্গালী হয়ে যারা বাঙ্গালীর ঘরে আগুন দিয়েছে, বাঙ্গালী মা,বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতনে মদদ জুগিয়েছে, শরীক হয়েছে, অহেতুক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তারা যে পক্ষের হোক না কেন ধর্মীয় ও মানবিক দিক থেকে তার অপরাধী। আর অপরাধীর বিচার সবসময়ই কাম্য। এটি নৈতিক, মানবিক ও প্রচলিত আইনের বিধান।
অপরাধীকে বিনা বিচারে ক্ষমা প্রদর্শন করা একটি ক্ষমাহীন অপরাধও বটে।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored