১৯৭০এর ৭ই ডিসেম্বরে সেনাশাসক ইয়াইয়া খান পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ২৩ বছর পর এবং সংযুক্ত পাকিস্তান থেকে বাঙলাদেশ বেরিয়ে আসার পূর্বে অনুষ্ঠিত একমাত্র জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠায় বিজয়ী হয় এবং ইয়াইয়া এই ঘোষণা পর্যন্ত দেন যে শেখ মুজিবই হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
তাহলে হিসেবের ভুল কোথায় হলো? কি এমন ঘটেছিলো যে পাকিস্তানের পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান হবার পথ থেকে সরে এসে শেখ মুজিব স্বয়ং পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই অস্বীকার করলেন এবং ঘোষণা দিলেন যে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম?”
৭১এর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পিপিপি বা পাকিস্তান পিপল’স পার্টির প্রধান জুল্ফিকার আলি ভুট্টো যুদ্ধের সমস্ত দায়ভার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক প্রশাসক ইয়াইয়া খানের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি সরকার ও সেনাবাহিনী উভয় থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন এবং পরবর্তীতে ৬৫’র যুদ্ধসহ দীর্ঘ সামরিক কর্মজীবনে অর্জিত সমস্ত সম্মাননা থেকে বঞ্চিত হন। সামরিক একজন অধিকর্তার জন্য এরচেয়ে বেশী লাঞ্চনা আর হয় না এবং মৃত্যুর পূর্বাবধি তাকে এই নিগ্রহের জীবন যাপন করতে হয়েছে। ইয়াহিয়া কোন সাধু ছিলেন না, নিষ্পাপতো মোটেই না কিন্তু পাকিস্তান ভঙ্গের সকল দায় একা তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়তো অনুচিত।
৭০এর ডিসেম্বরে এটা পুরোপুরিই নিশ্চিত ছিলো যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ের ফলে শেখ মুজিবই হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কিন্তু প্রস্তাবটি ভুট্টো মেনে নিতে পারলেন না এবং তিনি এই ক্ষমতা হস্তান্তরে সহযোগিতা করতে সরাসরি অস্বীকার করলেন।
চিত্তাকর্ষক দিক হলো বিরোধিতার কারণ এ নয় যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে তার কোন অনুযোগ ছিলো। বহু পাকিস্তানী সেটিকে আজতককার পাকিস্তানের সবচেয়ে সচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে মেনে থাকেন।
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিলো, ভূট্টোর সমস্যা ছিলো শেখ মুজিব তথা একজন বাঙালী তাতে বিজয়ী হওয়ায়! পাকিস্তানের জনমানসে বাঙালীদের অত্যন্ত নীচু চোখে দ্যাখা হয় এবং আজপর্যন্ত পাকিস্তানী গণমাধ্যমগুলোয় বাঙালীদের হাস্যস্পদ ভাবে চরিত্রায়ন করা হয়। স্বভাবতই কোন পশ্চিম পাকিস্তানী জিতলে ভূট্টোর আপত্তি ছিলো না কিন্তু একজন বাঙালী পাকিস্তান শাসন করবে, এই ধারণাটিও তার সহ্যের বাইরে ছিলো! ভূট্টো মনে করেছিলেন যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সমুহ পরাজয়ের পরও, সরকার কে গঠন করতে পারবে এ বিষয়ে তাঁর “অনুমোদন” গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জনগণের ভোটে নির্ধারণ হন না বরং নির্বাচিত সাংসদরা একজন প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করেন, শেখ মুজিবের পক্ষে অধিকাংশ সাংসদ থাকায় সাংবিধানিকভাবে তারই দেশ পরিচালনার ভার পাওয়ার কথা, সিন্ধ বা পাঞ্জাবের একজন নেতার তাতে কি অনুভূতি হলো সংবিধানে তাতে কিছুই যায় আসে না। শুনতে আশ্চর্য লাগে কিন্তু বাস্তবপক্ষে তাই হয়েছিলো, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নিরংকুশভাবে বিজয়ী প্রার্থী শেখ মুজিবকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি ভুট্টোর আপত্তির কারণে!
যদিও একথা সম্পূর্ণ সত্য যে সেটা ছিলো, গড়পড়তা পাকিস্তানে য্যামনটা হয়, সামরিক শাসনের আমল এবং যাকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো সে বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ দায়দায়িত্ব ইয়াইয়া খানেরই। জন্মের সিকি শতাব্দী না পেরোতেই সংযুক্ত পাকিস্তান ও তার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাঙন এই কারণে হয়েছিলো যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতা একজন বাঙালীকে দেশের শাসক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি এবং একজন সামরিক একনায়ক তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব স্বত্বেও এহেন জাতিগত উন্নাসিক মানসিকতাকে ক্যাবল প্রশ্রয় নয় বরঞ্চ সমর্থন জুগিয়েছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে গড়া মুহাম্মদ আলী জিন্নার “একজাতি” ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে নিজেরই একাংশকে নিগ্রহের শিকার করলো।
ভুট্টোর ভূমিকা যাহোক শুধুমাত্র মানসিকতার মধ্যেই সীমিত ছিলোনা, তিনি সংসদে অংশগ্রহণ করতে সাফ মানা করে দিলেন, ফলশ্রুতিতে তৈরী হলো কোরাম সংকট, ক্যাননা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার সাংসদ উপস্থিত না থাকলে নিয়মানুযায়ী সংসদ তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না, শুধু তাই না তিনি হুমকী দিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন নির্বাচিত সাংসদ যদি তেসরা মার্চের ঢাকা অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে যায়, সে য্যানো ঢাকাতেই বসতি স্থাপন করে, ক্যাননা তাকে আর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরতে দেওয়া হবে না। তাস্বত্বেও কিয়দ সংখ্যক সাংসদ দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা দূর করতে অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তিনি সরাসরি হুমকি দেন যে যদি কেউ ঢাকায় যাবার চেষ্টা করে তবে তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেওয়া হবে!
ফলে ইয়াইয়া চাইলেও আর স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারতেন না। বাঙালীদের প্রতি ভুট্টোর এই নীচু দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ করেই খুব প্রকট হয়ে উঠেছিলো এবং স্বভাবতইঃ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা তাতে খুব বেশী মুগ্ধ হতে পারেননি।
ভুট্টোর সহিংস হুমকীর মুখে পশ্চিম পাকিস্তানী কোন সাংসদ পূর্ব পাকিস্তানে আসতে সাহস পেলেন না, যাহোক পূর্ব পাকিস্তান হতে নির্বাচিত সাংসদরা যারা ইতিমধ্যেই ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তাদের জন্য “আর পশ্চিম পাকিস্তানে না ফিরতে পারাটা” খুব ভীতিকর কোন সম্ভাবনা ছিলোনা, বিশেষ করে এই অনুধাবনের পর, যে দেশের পশ্চিম অংশের নেতারা তাদেরকে সমমর্যাদা দূরে থাক সামান্য মানুষ হিসেবেও গণ্য করেন না।
এটা ছিলো যুল্ফিকর আলী ভুট্টো যে কায়েদে আজমের দ্বিজাতিতত্ত্বের স্থলে “দুই পাকিস্তান ত্বত্ত্ব” উদ্ভাবন করলেন। শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ সমগ্র পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয় লাভ করলেও মাত্র ১৮.৬ শতাংশ ভোট ও ৮১টি আসনপ্রাপ্ত ভুট্টো ঘোষণা দিলেন যে মুজিব “শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ” নেতা, সমগ্র পাকিস্তানের নয়। এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টি (PPP) হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সেই অনুযায়ী পাকিস্তানে দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান হবে, পূর্বাংশের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী… অবশ্যই ভুট্টো!!
এমন কোন বিধি যাহোক পাকিস্তানের সংবিধান কর্তৃক সমর্থিত ছিলো না, তার উপর মুজিব তুলে ধরলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪ প্রদেশের মধ্যে ভুট্টোর পিপিপি পাঞ্জাব ও সিন্ধু মাত্র এই ২টি প্রদেশেই বিজয়ী হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টির মধ্যে মাত্র ৮১টি আসনে জিতে। বেলুচিস্তান ও সীমান্ত (আজকের খাইবার) প্রদেশে বিজয়ী হয়েছে জাতীয় আওয়ামী পার্টি (NAP) যা আদর্শিক ভাবে আওয়ামী লীগেরই নিখিল পাকিস্তান রুপ।
জাতীয় আওয়ামী পার্টি ৬৯এর গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ৬ দফার পূর্ণ সমর্থক ছিলো এবং পশ্চিম পাকিস্তানে একই দাবী নিয়ে আন্দোলন করেছে। অর্থাৎ ভৌগলিক হিসাবে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অর্ধেকেরও কম অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করছেন আর জনসংখ্যার এক পঞ্চাশেরও কম, তাই পুরো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বের তাঁর দাবী ধোপে টেকে না।
সবচেয়ে বড় কথা পাকিস্তানের “জাতীয় নির্বাচনে” জিতে শেখ মুজিব ক্যানো শুধুমাত্র একটা প্রদেশের দ্বায়িত্ব নিতে যাবেন? তিনিতো পুরো পাকিস্তানেরই নেতা। কথাটা অযৌক্তিক ছিলোনা, কারণ আজকের পাকিস্তানের শতকরা ৬০ ভাগ আসন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আসে এবং শুধুমাত্র পাঞ্জাবে জয়যুক্ত কোন নেতার পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতা নিতে কোন বেগ পেতে হবেনা।
মাশরিকি (পূর্ব) পাকিস্তানের আলাদা হওয়ার পেছনে ইয়াইয়ার মূল ভূমিকা শুরু হয় ভুট্টো আর মুজিবের মধ্যে সংলাপ ভেস্তে যাবার পর। পাকিস্তানের “মহাশক্তিধর” এই সেনাশাসক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা দূর করার নামে গোপনে লক্ষাধিক সৈনিক ঢাকায় প্রেরণা করলেন এবং বৈঠকে যুক্তিতর্কে জিৎতে না পেরে বাঙালীদের কুকুরসম জ্ঞান করে নিজের উর্ধতন সেনাকর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন যে “ওদের (বাঙালীদের) ৩০ লক্ষকে মেরে দাও, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খুঁটে খাবে। (Kill three million of them & the rest will eat out of our hands). যা অবশ্যই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি।
২৫শে মার্চের রাত ১১টায় ঢাকার নিরস্ত্র মানুষদের ওপর পাকার্মীর চালানো প্রথম গুলিতেই (Operation Search Light) নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো যে এই ভূমির প্রতিটা সন্তান নিজের জীবনের শেষ শ্বাস ও শরীরের শেষবিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও স্বাধীনতার জন্য লড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…
সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…
পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…
রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…
Leave a Comment