মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ঃ মহান স্বাধনিতা সংগ্রমের সময়ে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় রাউজানের গহিরা বিশ্বাস বাড়ী, কুন্ডেশ্বরী ভবন, সুলতানপুর জগৎমল্ল পাড়া, চিকদাইর, সুলতান পুর ছিটিয়াপাড়া, রাউজানের পাহাড়তলী উনসত্তর পাড়া এলাকায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাউজানের শতাধিক নারী পুরুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। ঐদিন রাউজানের কুন্ডেশ্বরী ভবনে হানা দিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কুন্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয় ও বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নতুন চন্দ্র সিংহকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে । অধ্যক্ষ নতুন চন্দ্র সিংহকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার পর রাউজানের সুলতান পুর জগৎমল্ল পাড়া গ্রামে হানা দিয়ে ৩৫ জন নারী পুরুষকে লাইন করে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন । একই দিন রাউজানের গহিরা বিশ্বাস বাড়ী, সুলতান পুর ছিটিয়া পাড়া, রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তর পাড়া এলাকায় শতাধিক নারী পুরুষকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় ।
সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস মার্কিন সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক খুন ও বেসামরিক লোকদের যথেচ্ছ হত্যার খবরে আমি আতঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশী সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের যে নীতি পাকিস্তান সরকার অনুসরণ করছে তার ফলে কংগ্রেসের সদস্যবর্গ ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানে কি ঘটছে তা জানা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লোকদের পাইকারি হত্যা ও নির্বিচারে খুন-খারাপির খবরগুলো যদ্দিন পর্যন্ত না অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে তদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।
সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি ও কন্ট্রোল রুম ঠাকুরগাঁও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত ২০টি প্রতিরক্ষা ক্যাম্প তুলে নিয়ে সীমান্তে অবস্থান নেয় এবং নেতৃবৃন্দ শহর ছেড়ে চলে যায়।
গোয়ালন্দ ঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনী পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
সিলেট শহর সংলগ্ন লাক্কাতুরা চা বাগানের অসংখ্য চা শ্রমিককে পাক হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে।
নড়াইল শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়।
সকালে ক্যাপ্টেন নওজেশের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ভারি অস্ত্রে আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে তিস্তা ব্রিজের অবস্থান ছেড়ে দেয় এবং পিছু হটে শিঙ্গের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাট নামক স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়।
পাকবাহিনী টাঙ্গাইল দখলের পর ময়মনসিংহ শহর দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে এলে মধুপুর গড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পথ রোধ করে । দুপক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের একজনও নিহত বা আহত হয়নি। অপরদিকে পাকবাহিনীর দুজন ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলেন অস্ত্রচালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র।
বগুড়া পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়।
বদরগঞ্জে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে মুক্তিযোদ্দাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে।
পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে না এসে খানসামার পথ ধরে পিছন হতে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক পাকসেনারা খানসামার কাছে একটি নদী পার হতে থাকলে মুক্তিযোদ্দারা আক্রমণ চালায় এবং পাকবাহিনীর বালুচ ডি কোম্পানিকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে।
বানেশ্বরে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মক্তিসেনারা ছত্রভঙাগ হয়ে পড়ে। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদাৎ বরণ করেন। বানেশ্বর ও সেই সঙ্গে সারদার পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘বানেশ্বরেরযুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
সারদায় পাকসেনা চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় দুহাজার লোক নদীর ধারে আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনী সবাইকে ঘিরে ফেলে এবং গুলি করে ও পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে প্রায় ৮০০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ বেদনাদায়ক ঘটনাটি মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সারদার গণহত্য’ নামে খ্যাত।
রাজশাহী সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনী আর্টিলারী, পদাতিক ও বিমান হামলা চালায়। পাকসেনাদের এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছূ হটে চাপাই নবাবগঞ্জ এলাকায় সমবেত হয় এবং গোদাগাড়িতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে।
বিকেল ৪টায় গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ অনেক সৈন্য মারা যায়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল শহীদ হন।
পাকবাহিনী পুনরায় রাজশাহী দখল করে।
ঢাকায় শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শান্তি কমিটি গঠনের পর এটিই ছিল তাদের বড় কর্মসূচি। এ মিছিলের সম্মুখভাগে ছিলেন-খান এ. সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আজম, এ.এস.এম সোলায়মান, এ.কে.এম শফিকুল ইসলাম, এ.টি.সাদী, আবুল কাশেম, সৈয়দ আজিজুল হক, আতাউল হক, মেজর আফসার উদ্দিন, কবি বেনজির আহম্মদ, পীর মোহসেন উদ্দিন,অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রকাশনা।
সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।