মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ২০ এপ্রিল ১৯৭১ঃ দিনটি ছিল শুক্রবার। এইদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার অন্তর্গত ১৩ নং মায়ানী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সৈদালী গ্রামে লুটতরাজ, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নৃশংসভাবে ২৩ জন নীরিহ গ্রামবাসীকে হত্যাসহ কয়েকজন অবলা নারীকে ধর্ষন ও গ্রামের সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গ্রামটিকে বিরাণভূমিতে পরিণত করে দিয়েছিল।
লোহাগাড়ার মাটি ও মানুষকে আজও কাঁদায় ভয়াল ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিলের স্মৃতি। সময় জুমার নামাজ চলাকালীন। ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা অন্য মসজিদের মতো যথাসময়ে বটতলী মোটর স্টেশনস্থ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে সমবেত হন। পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ভয়-ভীতি আতঙ্ক বিরাজ করছিল সর্বত্র। মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত। স্বাভাবিক জনজীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। পাকবাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছিল পটিয়ায়। ওই ধরনের আক্রমণের আশঙ্কায় লোহাগাড়ার মানুষও ছিল ভীত সন্ত্রস্ত। অবশেষে ওই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো ২০ এপ্রিল জুমার নামাজ চলাকালে। যার যার মতো আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিক ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা বটতলী স্টেশনস্থ জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করছিলেন।
ক্ষুধার্ত বাঘের মতো নরঘাতক পাকবাহিনী হঠাৎ দুটো জঙ্গি বিমান নিয়ে হামলা চালায় মোটর স্টেশনে। বোমা নিক্ষেপ ও মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে নিরীহ মানুষের ওপর। ওইসময় আত্মরক্ষায় শোর-চিৎকার করে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। নিমিষেই পুরো এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এবং মেশিনগানের গুলির আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন আবদুস ছালাম (২২)। তার পিতার নাম মরহুম আলতাফ মিঞা। স্টেশনের উভয় পার্শ্বে বাঁচা মুন্সীর পাড়ায়। একই সময় অগ্নিদগ্ধ হয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় অনেক দোকানপাট ও মালামাল পুড়ে আর্থিক হয়রানির সম্মুখীন হন অনেক দোকানি। আবার ছোটাছুটিতে অনেকেই আহতও হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে,আজ হিলিতে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিবাহিনী সিলেট পাকবাহিনীর একটি দলকে শেওলা ঘাট এলাকায় আক্রমণ চালায়। এতে ৮ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা শেওলাঘাট ফেরী ধ্বংস করে পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করে।
মুক্তিবাহিনীর মীরসরাই অবস্থানের ওপর পাকবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ান ভারি অস্ত্র-শস্ত্রসহ আক্রমণ চালায়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে শতাধিক শত্রুসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মীরসরাই ত্যাগ করে মাস্তান নগরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। মধ্যরাতে পাকবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে মাস্তান নগর আক্রমণ করে। ভোর রাতে মুক্তিবাহিনী মীরসরাই অবস্থান ত্যাগ করে। হিংগুলিতে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে।
ন্যাশনাল আওযামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বিবৃতিতে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের মুক্তি ও গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
গর্ভনর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগ নেতা তাজুদ্দীন আহমদ, এস.নজরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও দি পিপল-এর সম্পাদক আবিদুর রহমানকে আগামী ২৬ এপ্রিল সকাল ৮ টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
নেজামে ইসলাম পার্টির আলহাজ্ব সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, হাজী আকিল সাহাব, আ্যাডভোকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, মওলানা আজিজুল হক ও হাফেজ আহমদ করিম ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযোগিতায় সশস্ত্র হানাদারদের (মুক্তিযোদ্ধা) অনুপ্রবেশ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর পরিষ্কার হামলা স্বরূপ।
ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শান্তি কমিটির নেতারা দেশের সব জায়গায় শান্তি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপারে যোগাযোগের জন্য গোলাম আজম, মাহমুদ আলী, এ.জে. খদ্দর, আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রতিবেদন।
সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।