মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ২৭ এপ্রিল ১৯৭১ঃ আজ শেরে বাংলার মৃত্যুবার্ষিকী শেরে বাংলার মৃত্যু বার্ষিকীকে কলঙ্কিত করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। এ.টি. সাদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান দরদী সংঘের (শান্তি কমিটির শরিক ) এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন অ্যাডভোকেট মোজাফফর হোসেন ও মীর আবুল ফজল।
ডাক্তার নূরুর রহমানের সভাপতিত্বে কনেভনশন মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, এএনএম ইউসুফের(মুসলিম লীগ) সভাপতিত্বে মোক্তার বার সমিতি আলোচনা সভার আয়োজন করে । সভায় বক্তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তান রক্ষার আহবান জানায়।
এইদিন চট্টগ্রাম জামাতের আমীর অধ্যাপক ওসমান রমিজ করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভাষণে বলেন পূর্ব-পাকিস্তানের কোনো দেশপ্রেমিক মুসলমান বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষে নয়। এক শ্রেণীর ভারতীয় দালাল পাকিস্তানিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। এরা ইসলাম ও পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থী পুস্তক প্রকাশ করে বিভেদ সৃষ্টি করছে। তিনি দুষ্কৃতকারীদের উৎখাতের পাশাপাশি পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী এসব পুস্তকের প্রকাশনা বন্ধ করার আহবান জানান।
( নোটঃ ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারী পল্টনের ইয়াহিয়া যুগের জামাতের প্রথম সমাবেশে এই নেতার উস্কানি মুলক বক্তব্বের জের ধরে ছাত্রলীগের গন পিটুনিতে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ বিরতির পর তাকে দেখা যায়)
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে,২৭ এপ্রিল, ১৯৭১ কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়।
পাকহানাদার বাহিনী বিমান হামলার পরক্ষণেই সুযোগ বুঝে সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকে পড়ে।
বিকেলে পাকবাহিনীর বিশাল দল মুক্তিযোদ্ধাদের মহালছড়ি হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে খাগড়াছড়ি এসে ডিফেন্স নেয়। ক্যাপ্টেন কাদের যুদ্ধ কালে শত্রুর গুলিতে শহীদ হন।
পাকবাহিনী জনতার প্রতিরোধ ভেঙে চকরিয়ায় প্রবেশ করেই চিরিঙ্গার হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ চালায়।
পাকবর্বররা আওয়ামী লীগ নেতা এস.কে শামসুল হুদা, দেলোয়ার হোসেন, সারদা বাবু ও নূরুল কবিরসহ বহু নেতা ও কর্মীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনীর হামলায় আওয়ামী লগি নেতা সারদা বাবুর ছেলে মনীন্দ্র ও লক্ষ্যচরস্থ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আবুল কালামের ভাই আবুল হোসেন শহীদ হন।
পাকহানাদার বাহিনী জগন্নাথপুর থানায় প্রবেশ করে ব্যারিস্টার আবদুল মতিনের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকহানাদাররা অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে এলাকার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
শাহবাজপুরে পাকবাহিনীর ওপর সফল আক্রমণ চালিয়ে লে. মোরশেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দল মাধবপুরে প্রত্যাবর্তন করে। উক্ত তৎপরতায় পাকিস্তান বাহিনীর কিছু সৈন্যহতাহত হয়।
চট্টগ্রামের হিকুয়া নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর প্রচন্ড প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। রামগড় দখলের জন্য হিকুয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান।
পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের ডাব-বাগানে (বর্তমান শহীদনগর) মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে সিপাহী নেফরিুল হোসেন, সিপাহী রমজান আলী, ল্যান্স নায়েক ফজলুর রহমান, হাবিলদার মোকসেদ আলীসহ ১৭ জন বীরযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে ৩০-৩৫জন শত্রু সৈন্য হতাহত হয়।
প্রচন্ড সংঘর্ষের পর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নোয়াখালী, সান্তাহার, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পুনর্দখল করে।
অধিকৃত ঢাকার গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্থান রাইফেল’ (ইপিআর)-এর নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী’ (ইপিসিএফ) নামকরণ করে।
বৃটিশ এমপি জন স্টোনহাউস লন্ডনে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পূর্ব বাংলায় মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার ঘটছে। ঢাকায় ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করা হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী যা করছে তা নিঃসন্দেহে গণহত্যা। নির্বাচনে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোটার যে রায় দিয়েছেন, সামরিক জান্তা নেই গণতান্ত্রিক রায়কে কেবল প্রত্যাখ্যানই করেননি তা ভেস্তে দেবার পরিকল্পনা এঁটেছেন। এ বিষয়টি কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। এ ব্যাপারে আমাদের কত্যর্ব রয়েছে। আমাদের নিষ্ক্রয় থাকা উচিত নয়।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. রহিম খান ঢাকা আসেন। ঢাকায় তিনি সার্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বিমান হামলা সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণ করেন।
ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের জনৈক্ মুখপাত্র জানান, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস কন্সাল মাহমুদ আলী তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করায় তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৪৮নং সামরিক বিধি জারি করে। এ আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহায়তাকারীদের পাইকারী শাস্তির নির্দেশ দেয়া হয়। এ আদেশে কোনো কারণ ছাড়াই কেবলমাত্র সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে চরম শাস্তির লাইসেন্স দেয়া হয় ঘাতকদের। এমনকি যে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তৎপরতা চালাবে সে এলাকার লোকদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা লাভ করে দালালরা।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও সংগ্রামের নোটবুক।
সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।