সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored


মুক্তিযুদ্ধে ঈশ্বরদীর ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন ১১ই এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকসেনারা ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করেছিল। তাদের প্রবেশের সাথে সাথে ঈশ্বরদীতে অবস্থানরত বিপুল সংখ্যক অবাঙালি ও স্বাধীনতা বিরোধী কিছু বাঙালি কুলাঙ্গার জোটবদ্ধ হয়ে পাকসেনাদের স্বাগত জানিয়ে লুটপাট ও হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়।

আমার মনে আছে আমাদের প্রিন্টিং প্রেস ও একটি রাইচ মিল ছিল নাজিমউদ্দিন হাইস্কুলের পাশে হ্যান্ডব্রেক মুকুল ভাইদের জায়গার উপর। বড় ভাই অধ্যাপক নাসির আহমেদ মার্চের উত্তাল আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে আব্বার দোনালা বন্দুকটি নিয়ে তৎকালীন ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের ভিতরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের সাথে ট্রেনিংয়ে অংশ গ্রহন করেন। ক্যাপটেন আজিজ তাঁদেরকে ট্রেনিং দিতেন।


আম্মাসহ ছোট ভাইবোনদের নিয়ে আব্বা আমাদের গ্রামের বাড়ি মাঝগ্রামে চলে গেছেন। সেজ ভাই কামাল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে অন্যান্যদের সাথে ভারতে গেছেন। মেজ ভাই জালাল আহমেদ পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ছিলেন, তখন দেশে এসে পাকসেনাদের হাতে আটক হন। স্বাধীনতার পর ঢাকা ক্যান্টমেন্ট থেকে অন্যান্য বন্দিদের সাথে অলৌকিকভাবে মুক্ত হন।
আমি ও চাচাতো ভাই বাশার বাড়ি আর প্রেস-মিল পাহারা দিতাম। আমাদের মহল্লা তখনকার নতুন বাজারে (এখন নুরমহল্লা) আমরা মাত্র কয়েকটি পরিবার ছিলাম বাঙালি, বাকী সবাই ছিল অবাঙালি। এরমধ্যে কোন কোন বাঙালি পরিবার চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।

আমার জীবনের একটি ভয়াবহ দিন ছিল ১১ই এপ্রিল। এদিন সকালে চাচাতো ভাই বাশারও গ্রামে গেল কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসার কথা বলে। চারিদিকে নি:ঝুম নিরবতা। এক ধরনের ভয় আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। দুপুরের দিকে রাস্তায় মানুষ চলাচল নেই বললেই চলে। এই মহল্লার অবাঙালিরা মার্চের শুরুতেই সকলে লোকোসেড এলাকায় চলে গেছে।

বিকেলে আমি বাসার সামনে অবাঙালি ওয়ালি খানের বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে মন খারাপ করে বসে আছি। রাস্তায় কোন মানুষের দেখা পাচ্ছিনা। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। বাশার ভাইও আসছেনা। কেমন যেন একটা অস্তত্বিভাব আমাকে পেয়ে বসলো। হঠাৎ দেখি বড় ভাই খুব দ্রæত হেঁটে বাড়ির দিকে আসছেন। আমাকে ওভাবে এখানে দেখে অস্থির হয়ে রাগারাগি করলেন। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি রেডি হ, আমরা এখান থেকে চলে যাবো। পাকসেনারা নগরবাড়ি ঘাট পার হয়েছে, যেকোন সময় ঈশ্বরদী চলে আসবে। বড় ভাই এখানে এসেছিলেন শেষবারের মত বাড়িটি দেখে যেতে।

আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে ও বাইরের গেটে তালা দিয়ে বাশারের জন্য বড় ভাইয়ের লেখা একটি চিরকুট তালার সাথে গুঁজে দিয়ে রওনা হলাম। চিরকুটটি ছিল বাশারের জন্য, যাতে সে আসামাত্র এখান থেকে আবার গ্রামে চলে যায়। যাহোক বড় ভাইকে পেয়ে আমি যেন প্রান ফিরে পেলাম। আমরা দু’জন যাওয়ার সময় স’মিলের পাশে আমার বাল্যবন্ধু দিলিপকে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে বড় ভাই ওকে বললেন, তোরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যা, যেকোন সময় আর্মি ঢুকবে। তোর বাবাকে যেয়ে বল। আমরা তখন এইটের ছাত্র, দিলিপ বড় ভাইয়ের কথার গুরুত্ব কতটুকু বুঝলো সেই জানে।

আমরা বাড়িতে সবকিছু রেখে রওনা দিলাম, আবার যখন ১৮ই ডিসেম্বর-১৯৭১ ফিরে আসলাম তখন বাড়ির কিছুই ছিলনা, আমরা পেলাম একটি বড় আকারের বাংকার। আব্বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলতেন, বড় ভাইয়েরা মুক্তিযোদ্ধা এসবই বিহারীরা জানতো। ফলে সেই প্রতিশোধ নিতে রাজাকাররা বাড়ির ইট পর্যন্ত ওরা খুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ি টর্চার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতো অবাঙালি ও রাজাকাররা।
আমরা ঈশ্বরদী ডাকবাংলোর সামনে বড় টিনসেড বাড়িতে (স্বাধীনতার পর মান্নান ভাই এখানে বাড়ি করেছেন) গেলাম। এখানে ক্যাপটেন আজিজসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা বড় ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাদের একটি জিপগাড়িতে উঠলাম মুলাডুলির দিকে যাওয়ার জন্য।

মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল ওইখানে রেলগেট ও রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া। মুলাডুলিতে পৌঁছে পরিচিত কাউকে পেলে বড় ভাই আমাকে মাঝগ্রামে পৌঁছে দিতে বলবেন এমনটি ভেবেছিলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খবর ছড়িয়ে গেছে চারিদিকে যে পাকসেনারা আসছে। মুলাডুলি বাজার শুন্য হয়ে গেছে। তেমন কাউকে পাওয়া গেলনা। বড় ভাই ক্যাপটেন আজিজকে বিষয়টি বললেন। তিনি বললেন, আপনার ছোট ভাইকে নিয়ে গ্রামে যান। তবে আবার এখানে ফিরে আসার দরকার নেই। আপনি ভারতে চলে যাবেন ট্রেনিং এর জন্য, বেঁচে থাকলে সেখানে দেখা হবে।


আমরা দু’জন সন্ধ্যার আঁধারি রাস্তায় হেঁটে প্রায় চার মাইল পথ পেরিয়ে মাঝগ্রাম পৌঁছুলাম। আমাকে ও বড় ভাইকে পেয়ে আব্বা-আম্মাসহ সবাই আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়লো। আমার জন্য বাবা-মা মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। যাহোক রাতেই বড় ভাই ও আব্বা চাচাতো ভাইদের বললেন বড় গর্তখুঁড়ে তাতে প্রয়োজনীয় পরিমান চাল-ডাল ও শুকনো খাবার রেখে দিতে যাতে জরুরি দরকারে সেগুলো কাজে লাগানো যায়। আব্বার সাথে ছিল একটি লাইসেন্স করা রিভলবার। তিনি সবাইকে বাঁশের লাঠি, ফালা, সড়কি ইত্যাদি অস্ত্র হাতের কাছে রাখতে বললেন। আব্বা রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। সেই সময় নিয়মিত রেডিওতে খবর শুনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সশস্ত্র লড়াই ছাড়া পশ্চিমারা কোন কিছু শুনবেনা।

ইতোমধ্যে ১১ই এপ্রিল রাতে ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করলো পাকসেনারা। গ্রাম থেকেই শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ। বিহারীদের বিভৎস রূপ সেদিন প্রত্যক্ষ করেছে অনেক মানুষ। যে দিলিপকে বারবার বড় ভাই বলে আসলেন, তোর বাবাকে বল এখান থেকে এখনি চলে যেতে। কিন্তু ওরা কথা শোনেনি। সেদিন রাতেই বিহারীরা দিলিপদের পরিবারের এগারো জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমাদের এলাকার হাজ্বী আব্দুল বারী, তার দুই ছেলে, ব্যবসায়ী নুর বক্স সকলেই হত্যার শিকার হন বিহারীদের হাতে।

পাকসেনারা রেলগেট অতিক্রম করে গোপালপুরের দিকে যাওয়ার সময় একজন পাগলকেও ওরা গুলি করে হত্যা করে। ওদের কাছে বাঙালি একজন পাগলও নিরাপদ ছিলনা। গভীর রাতে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছিল। ওইদিন বিকেলে যদি বড় ভাই বাড়িতে না আসতেন তাহলে আমার পরিনতিও হতো নির্মম খুন। এ যেন নতুন জীবন ফিরে পাওয়া।


গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত আহত অনেকেই মাঝগ্রামে আমাদের বাড়ির সামনের স্কুল মাঠে জড়ো হলো। এদের কাছ থেকে পাকসেনা ও বিহারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের অনেক খবর শোনা গেল। ভোর পর্যন্ত এখানে আগতদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও পানি-খাবারের ব্যবস্থা করা হলো গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে। আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠলো চারিদিক।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের পর কার্যত সারাদেশে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আব্বা, বড় ভাই ও গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের ভারতে যেতে হবে। এখানে থাকা শুধু বিপদজনকই নয়, প্রতিরোধমূলক কিছু করাও এখান থেকে সম্ভব হবেনা। প্রস্তুতি নিয়ে সবকিছু ফেলে রেখে পরদিন সকালে তখনকার একমাত্র বাহন দুটি গরুর গাড়িতে মেয়েদের ও শিশুদের তুলে দিয়ে অন্যান্যরা হেঁটে বর্ডারের দিকে রওনা হলাম। আমি সবসময় আব্বার সাথে থাকতে পছন্দ করতাম। এখানেও তার ব্রতিক্রম হলোনা। অস্ত্রের মধ্যে কয়েকটি বাঁশের লাঠি আর আব্বার সাথে থাকা একমাত্র রিভলবারটি সম্বল।

লেখক : আলাউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক-ঈশ্বরদী, কলাম লেখক ও সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored