স্বাধীনতা আন্দোলনের মাসীমা

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

জাতীয় রাজনীতিতে ম্যাডাম, আম্মা, পিসি, দিদি সবই তো শুনেছেন, কিন্তু মাসীমা ? শোনেননি তো, সেটাই স্বাভাবিক।

একে বাঙালি বাড়ির বউ তার ওপর মধ্য বয়সে এসে দীক্ষা নিয়েছেন মার্কসবাদে ! কি করে ঠাঁই পাবেন ইতিহাসের পাতায় ?

অথচ উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন এই বঙ্গললনা।

১৮৯৭ সালের ১৮ই নভেম্বর বরিশালে নরোত্তমপুর গ্রামে জন্ম এই কন্যার পিতৃদত্ত নাম মনোরমা।

বাবা নীলকন্ঠ রায় তার জন্মের দশ বছর পরেই মারা যান। অর্থাভাবে বিধবা মা প্রাইমারি স্কুল পাশের পর তাকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দেন।

চোদ্দ বছর বয়সে বাঁকাই গ্রামের জমিদারপুত্র চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কপাল গুনে স্বামী ছিলেন উদারমনা ও প্রগতিবাদী।

স্বামীর সহযোগিতায় ও সমর্থনে মনোরমা সংসারধর্ম পালনের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯০৫ সালে শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি মানুষের হাতে হলদে সুতোর রাখী বেধে দেশমাতৃকার জন্য বিপ্লবী কাজে উৎসাহ যোগাতেন।

১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের ফাঁসি তাকে ভীষন ভাবে নাড়া দেয়। মনে মনে শপথ নেন, একদিন তিনি দেশ থেকে ইংরেজদের যেতে বাধ্য করবেন।

১৯২৪ সালে বরিশালে আসেন মহাত্মা গান্ধী। সেসময় গান্ধীজির বক্তৃতা এবং ঐ জনসভায় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের গান তাঁকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে।

ধীরে ধীরে তিনি যুক্ত হয়ে পড়লেন নারী সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলার কাজে।

তখন থেকে তিনি কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে থাকেন এবং বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।

১৯৩০ সাল… সারা ভারত জুড়ে চলছিল আইন অমান্য আন্দোলন।

আঁচ পড়েছিল অবিভক্ত বাংলার বুকে ও । এই আন্দোলনে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ মনোরমা বসুকে গ্রেফতার করে। ছমাস জেল ও ১৫০ টাকা জরিমানা ধার্য হয়।

জেল থেকে বেরিয়ে পাশে পেলেন না স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের। পূর্ণোদ্যমে তখন শুরু করেন মহিলাদের সংগঠিত করার কাজ।

পাশাপাশি চালু করেন মেয়েদের বিদ্যালয়। স্কুলবাড়ি তৈরি করবার জন্যে শহরের উকিল, শিক্ষক এবং অন্যরা চাঁদা করে ৩০০ টাকা তুলে দিলে মনোরমা তাঁর গলার হার বিক্রি করে ২৫০ টাকা সংগ্রহ করলেন।

এই ৫৫০ টাকা পুঁজি করে বিদ্যালয়ের বাড়ি তোলার কাজে হাত দেয়া হল। এখানে মেয়েরা যে শুধু পড়াশোনা করত তা নয়, লণ্ঠণের ফিতা, সুতার কাজ এবং নানারকম কুটির শিল্পের কাজ শিখিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তোলা হতো।

কালক্রমে এই বিদ্যালয় বিখ্যাত ‘মাতৃমন্দির’ নামে পরিচিতি পায়। মূলত হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শত শত কুমারী মা এবং স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা যাদেরকে তিনি আদর-স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তারাই তাঁকে মায়ের মত আপন ভেবে ‘মাসিমা’ বলে ডাকতো।

ক্রমে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন, #মাসীমা ।

বরিশালে তখন কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা অমৃত নাগ একটি পরিচিত নাম। তাঁর প্রভাবেই মনোরমা কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত হন।

চুয়াল্লিশের মন্বন্তরের সময় মনোরমা সমগ্র বরিশাল জুড়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে শত শত মহিলাদের নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর যখন দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে যায় তখনো তিনি নিজের মা মাটিকে আঁকড়ে ওদেশেই থেকে যান।

১৯৪৮ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সামিল হন সরকার বিরোধী আন্দোলনে। পাকিস্তান পুলিশ অকথ্য নির্যাতনের পর গ্রেফতার করে তাকে, ভেঙে দেয় তাঁর সাধের মাতৃমন্দির।

চারবছর জেলে থাকার পর মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। জেলে তার সঙ্গী ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্র, নাচোলের রাণীমা।

ঢাকায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হলে আবার তার ওপর জারি হয় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা।

পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন তিনি আত্মগোপনে থাকেন।

সেই অবস্থাতেও বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় পার্টির কাজে নিজেকে নিয়েজিত করেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর ওপর থেকে গ্রেফতারী পরোয়ানা উঠে যায়।

নতুন করে গড়ে তোলেন মাতৃমন্দির ছাড়াও আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লী কল্যাণ অমৃত পাঠাগার ও মুকুল মিলন খেলাঘর ।

১৯৬৪ সালের দাঙ্গাবিরোধী কর্মকাণ্ডে মাসিমা সাহসের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। গোটা বরিশাল জুড়ে এ সময় তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন।

১৯৭০ সালে তিনি ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে ত্রাণকার্য বিতরণ ও আর্তমানুষের সেবায় নিজেকে নিয়েজিত করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনোরমা বসু প্রথমে দেশেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে জুন মাসে চলে যান ভারতে।

সেখানে গিয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

দেশ স্বাধীন হলে জানুয়ারি মাসেই তিনি ফিরে আসেন এবং পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত হন।

মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বয়স্কা মহিলাদের জন্য কালীবাড়ি রোডের চন্ডীসদনে স্থাপন করেন বৈকালিক স্কুল।

১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত নারী কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে রাশিয়া ভ্রমণ করেন।

১৯৮৩ সাল থেকেই তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগতে থাকেন। অবশেষে এই মহিয়সী নারী ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে মৃত্যুবরণ করেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরে।

মনোরমা বসুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ১৯৯২ সালে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।

১৯৯৭ সালে শের এ বাংলা পদক, ১৯৯৮ সালে মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মননা, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তাঁর রেখে যাওয়া যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে ২০০১ সালে বরিশালে তৈরি করা হয় ‘মনোরমা বসু মাসিমা স্মৃতি মন্দির’, সব ধর্মের দুস্থ আতুর মহিলাদের শেষ আশ্রয়!
আপামর বাঙালির এই মাসীমা কে শ্রদ্ধাঞ্জলি। ‌

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored