সুদূর মুম্বাই থেকে উড়ে আসা খ্যাতনামা এবং সম্ভ্রান্ত সেই অভিনেতা দম্পতির সামনে সেদিন বছর দুয়েকের নিশা’কে আনতেই চাননি অনাথআশ্রম কর্তৃপক্ষ কিংবা সহায়ক সংস্থার কর্মকর্তারা। গত দুই বছরে অনাথ আশ্রমে দত্তক নিতে আসা পরিবারদের মধ্যে প্রায় বারোটি দম্পতি নিশা’কে দত্তক নিতে রাজি হননি। কারণ! কেবলমাত্র ওই বছর দুয়েকের কন্যাশিশুটির গায়ের শ্যামলা রঙ এবং তার শারীরিক অসুস্থতা।
দত্তক নিতে আসা বাকী দম্পতিদের সাথেই সেদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই অভিনেতা দম্পতি। শুধুমাত্র নিজেদের পরিচিতির কারণে কোনোরকম অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা তারা নিতে চাননি। তাদের ইচ্ছা বলতে কেবলমাত্র এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নেওয়া। শিশুদের ঘরে ঢুকতেই প্রথমেই তাদের চোখ পড়ে ঘরের এক কোনে হাতে একটা আধছেঁড়া পুতুল নিয়ে খেলায় মত্ত এক ছোট্ট রাজকন্যার উপর। গায়ে আধময়লা একটি সাদা ফ্রক। চুল বাঁধা ঝুঁটি করে। স্ত্রী’টি আলতো পায়ে গিয়ে কোলে তুলে নেন মেয়েটিকে। ব্যাগ থেকে বের করে আনেন নিজের রুমাল এবং অতি সযত্নে মুছিয়ে দিতে থাকেন তার কপালের ঘাম। নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিতে থাকেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা খাবার। সারা আশ্রমে কুপয়া বলে পরিচিত বছর দুয়েকের নিশার প্রতি তাঁর এহেন আন্তরিক ব্যবহারে অনাথআশ্রমের কর্মকর্তারা যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন সেদিন।
বারোটি পরিবারের ফিরিয়ে দেওয়া সেই শ্যামলা বর্ণের অনাথ কন্যাশিশুটি আজ ভারতবর্ষের অন্যতম ধনী দম্পতির প্রথম সন্তান রূপে পরিচিত। নিশা কৌর ওয়েবার, সানি লিওনি এবং ড্যানিয়েল ওয়েবারের পরিবারের প্রথম সন্তান। অনাথ আশ্রমের সেই দশ বাই দশ কামরা থেকে আজ তার জীবনের সবটুকু জুড়ে রয়েছে বহুতল বিলাসবহুল বাংলো, অতি উন্নতমানের জীবনধারা, হাজারও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, এবং একজোড়া দায়িত্ববান মা-বাবা।
আজকে নিশার বয়স চার বছর। আজ তার মায়ের জন্মদিন। সেই মা যে তাকে সেই অনাথআশ্রমের অন্ধকার থেকে তুলে এনে সাজিয়ে দিয়েছে এই স্বপ্নের জীবনে। সেই মা যে আজও এই সমাজের বেশ কিছু মানুষের কাছে তার পূর্বতন পেশার কারণে হাসির এবং অসম্মানের খোরাক। আজও সমাজের বহুমানুষ যাকে অনায়াসেই বেশ্যা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। তার সেই মা যে আজও নিজের সামগ্রিক আয়ের প্রায় বিশ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন অনাথ আশ্রমের এবং ক্যান্সার হসপিটালের পিছনে। মুম্বাইয়ের বহু বস্তি এলাকার বহু পথশিশু যাকে আজও ‘মা’ বলেই ডাকে, বহু অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দু’বেলার পেটের খোরাক যোগান যিনি, জীবনের বিভিন্ন সময়ে যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া প্রায় তিন শতকেরও বেশী মেয়ের পড়াশোনার সামগ্রিক খরচা চালান যিনি, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন হসপিটালের প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশী ক্যান্সার বেডের গোটা বছরের সমস্ত খরচ বহন করেন যিনি, আজও প্রত্যেকটা অনাথ শিশুকে নিজের মাতৃত্ব ভাগ করে দিতে চান যিনি…
আজ তার সেই ‘মা’য়ের জন্মদিন।