আল্লাহ আমাদের কাউকে নারী কাউকে পুরুষ করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ আমাকে কেন নারী না বানিয়ে পুরুষ বানিয়েছেন বা আমা’র বোনকে কেন পুরুষ না বানিয়ে নারী বানিয়েছেন এর কোনো সদুত্তর আমাদের কাছে নেই এবং না থাকারই কথা।
এই সৃষ্টিতত্তের পেছনে আমাদের প্রশ্নও উচিৎ না। এই সৃষ্টির র’হস্য একমাত্র আল্লাহ জানেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কী’ করে সৃষ্টি করবেন একান্তই তার ইচ্ছে। এখানে অন্য কারো ইচ্ছে শক্তির নেই।
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ
অর্থাৎ: আসমান ও জমিনের একমাত্র কর্তৃত্ব আল্লাহর, আল্লাহ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন যাকে ইচ্ছে পুত্র সন্তান দান করেন। (সূরাতুশ শুরা : আয়াত নম্বর: ৪৯)।
আমাদের আলোচনার বিষয় হলো আম’রা সমাজে নারী নয়, পুরুষ নয়, তৃতীয় এক শ্রেণির মানুষ দেখতে পাই। আমাদের সমাজে যাদেরকে হিজড়া বলে ডাকে। হিজড়া আসলে কী’, তারা কী’ভাবে জন্ম লাভ করে, কেন হিজড়া হয়, তাদের আচার আচরণ কেমন, এমন সব প্রশ্নে অনেক কিছু আলোচনা করা যাবে। আম’রা ওই দিকে না গিয়ে হিজাড়ের মূলকথা কী’! এটা জানব সঙ্গে সঙ্গে হিজড়া স’ম্পর্কে ইস’লামের বক্তব্য কী’।
হিজড়া স’ম্পর্কে ইস’লামের বক্তব্য জানতে হলে আগে হিজড়াদের পরিচয় জানতে হবে-
হিজড়া পরিচিতি : হিজড়া হচ্ছে বিশেষ লৈঙ্গিক পার্থক্য সম্ভলিত মানুষ। যার লিঙ্গ সুস্থ নয়, অর্থাৎ কাজে অনুপযোগী। মোট’কথা যারা না পুরুষ না নারী প্রকৃতির। যদিও এদের চলাফেরা আচার আচরণ অনেকটা নারীসুলভ।
ইস’লামী শরিয়তে হিজড়া বলা হয় যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রী’লিঙ্গ উভয়টি রয়েছে। অথবা কোনটিই নেই, শুধু প্রশ্রাবের জন্য একটি মাত্র ছিদ্রপথ রয়েছে। মোট’কথা যার শরীরে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রী’লিঙ্গ উভয়টি বিদ্যামান তবে ত্রুটিযুক্ত। (কামু’সুল ফিকহ)।
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আম’রা বুঝতে পারি হিজড়ারা তিন ধরণের হয়ে থাকে।
পুরুষ হিজড়া : যেসব হিজড়াদের দাড়ি মোচ গোঁফ গড়ায়, স্বপ্নদোষ হয় এবং সহ’বাসের শখ জাগে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরের আকার আকৃতি সবদিক দিয়ে পুরুষের মতো মনে হয়।
নারী হিজড়া : যেসব হিজড়াদের স্তন ঋতুস্রাব সহ’বাসের উপযোগিতা, গর্ভ সঞ্চার হওয়াসহ নারীজনিত সকল কিছু বিদ্যমান থাকে।
পুরুষস্ত্রী’ হিজড়া : যেসক হিজড়াদের মাঝে নারীপুরুষের কোনো নিদর্শন নেই অথবা উভয় ধরনের নিদর্শন সমানভাবে বিদ্যমান তারাই তৃতীয় শ্রেণির হিজড়া। শরিয়তে তাদেরকে ‘কুনসায়ে মুশকিলা’ বা প্রকৃত হিজড়া বলে।
আল কোরআনে হিজড়া : অনেকেই মনে করেন কোরআনে হিজড়াদের কোনো আলোচনা নেই। এই ধারণাটি একদমই মিথ্যা। কোরআন সাধারণ নারী পুরুষের আলোচনা করে। তবে কোনো কোনো আয়াতের ব্যাপকতা মধ্যে হিজড়াদের প্রসঙ্গও এসেছে। ই’মাম কুরতবি (রহ.) তার লিখিত ‘আলজামে ফি আহকামিল কোরআন’ এর মধ্যে সুরাতুশ শুরার ৪৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যাতে বলেন, অনেকে বলতে চায় হিজড়াদের আলোচনা কোরআনে নেই। এটা যারা বলে তারা কোরআনের আয়াতের ব্যাপকতার প্রতি নজর বুলায় না। আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন’। অ’ত:পর বলেন ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন যাকে ইচ্ছে পুত্র সন্তান দান করেন’। আয়াতের প্রথমাংশের ব্যাপক সৃষ্টি যে কথা বলেছেন তাতেই হিজড়াদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
হাদিস শরিফে হিজড়া : হাদিস শরিফে স্পষ্ট করে হিজড়াদের আলোচনা এসেছে। শুধু আসেনি তাদের বিধান স’ম্পর্কেও বলা হয়েছে। হ’জরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত,
عن بن عباس أن رسول الله صلى الله عليه و سلم سئل عن مولود ولد له قبل وذكر من أين يورث فقال النبي صلى الله عليه و سلم يورث من حيث يبول.
অর্থাৎ : হ’জরত আব্দুল্লাহ আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক গোত্রের নবজাতকের মীরাস স’ম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, যে নারী নয়, পুরুষও নয়’ তার মীরাস কী’? উত্তরে রাসূল বলেন তার মীরাস নির্ণিত হবে তার প্রস্রাবের পথকে কেন্দ্র করে। (সুনানি বাইহাকি কবরা ৬/২৬১)।
হ’জরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত,
أن عليا رضي الله عنه سئل عن المولود لا يدري أرجل أم امرأة فقال علي رضي الله عنه يورث من حيث يبول
অর্থাৎ : হ’জরত আলী (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলের কাছে জানতে চাওয়া যার নারী পুরুষ হওয়ার কোনটাই স্পষ্ট নয় তার বিধান কী’? মিরাসে ক্ষেত্রে। তিনি বলেন তার হুকুম আরোপিত হবে তার প্রস্রাবের রাস্তা দেখে। (সুনানি বাইহাকি কবরা ১২২৯৪)।
হিজড়াদের শরয়ি বিধান : আমাদের সমাজের বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, আম’রা বা হিজড়া সবাই যেন মনে করি হিজড়াদের জন্য কোনো শরয়ি বিধান নেই। তাদের ওপর কোনো নামাজ রোজা হ’জ জাকাত আমল আখলাক ইবাদত নেই। সবাই যেন মনে করি তারা দুনিয়াতে থাকবে খাবে আর মা’রা গেলেই শেষ! নামাজ রোজা ইবাদত আর পরকালীন হিসাব শুধু আমাদের। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অজ্ঞতা। আম’রা যারা সুস্থ নারী পুরুষ তাদের ব্যাপারে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাদেরকে হেদায়াতের পথে আনা, নামাজ রোজা ইবাদতে দাওয়াত দেয়া আমাদের কাজ। একারণে আমাদের ইস’লামী আইনশাস্ত্রবিদগণ ফুকাহায়ে কেরাম তাদের রচনাবলিতে ‘বাবুল খু’নসা’ (হিজড়া অধ্যায়) শিরোনামে আলোচনা করেছেন।
তাদের নামাজ রোজা ও ইবাদতের হুকুম আহকাম বর্ণনা করেছেন। আম’রা আগেই জেনেছি হিজড়া তিন শ্রেণির। প্রথম শ্রেণি পুরুষ হিজড়া। তাদের শরিয়ত পালনের সকল হুকুম আহকাম একজন সুস্থ পুরুষের হুকুম আহকামের মতো। সাধারণ পুরুষগণ যেভাবে শরিয়ত পালন করেন ইবাদত আমল আখলাক গঠন করেন পুরুষ হিজড়াও সেইভাবে করবে। দ্বিতীয় প্রকার হিজড়া হলো নারী হিজড়া। তাদের শরিয়ত পালনের সকল হুকুম আহকাম একজন সুস্থ নারীর হুকুম আহকামের মতো। সাধারণ নারীগণ যেভাবে শরিয়ত পালন করেন ঈ’মান আমল ইবাদত পর্দাপুশিদা আখলাক গঠন করেন নারী হিজড়াও সেইভাবে করবে। তৃতীয় শ্রেণির হিজড়া যারা প্রকৃত অর্থে হিজড়া। তাদের ব্যাপারে কোরআন হাদিস কী’ বলে শুনুন-
পর্দার বিধান : এই শ্রেণি হিজড়াদের পর্দা করতে হবে এবং নারীদের মতোই তার পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে। (আলরাহরুর রায়েক ৯/৩৬)।
প্রকৃত হিজড়ারা আজান ইকামত দিতে পারবে না। (আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২২)।
এমন হিজড়াদের জন্য পুরুষের বা তার মতো হিজড়াদের ই’মামতি করা জায়েজ নেই। তবে শুধু নারীদের ই’মাম হওয়ার সুযোগ আছে। তবে মাকরুহ হওয়ার কথা জানিয়েছেন ওলামায়েকেরাম। (আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৫)।
জামাতের নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে উড়না পরিধান করা এবং পুরুষের পেছনের কাতারে দাঁড়াবে। আর নামাজে বসার ক্ষেত্রে নারীদের মতো করে বসবে। (আলরাহরুর রায়েক ৯/৩৫)।
তারা হ’জের সকল হুকুম আহকাম নারীদের মতো করবে। মাহরাম পুরুষ ছাড়া তারা হ’জে জেতে পারবে না। (আলরাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬)।
তাদের জন্য সবধরণের অলঙ্কার পরিধান করা মাকরুহ। কারণ পুরুষের জন্য অলঙ্কার পরিধান করা হারাম আর নারীদের বেলায় মুবাহ। আর যেহেতু তার মধ্যে পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই অলঙ্কার পরিধান করা মাকরুহ। (বাদায়ে সানাইয়ে ৭/৩২৯)।
এই শ্রেণি হিজড়াদের খতনা করাতে হবে। (আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/৩০)।
এই শ্রেণি হিজড়াদের স্তনে যদি দুধ আসে আর সেই দুধ কেউ পান করে, তবে এই পান করার দ্বারা রাজাআত সাব্যস্ত হবে না অর্থা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা আরোপিত হবে না। তবে যদি কোনো পুরুষ তাকে কামভাবসহচুম্বন বা এজাতীয় কিছু করে তা হলে বৈবাহিক নিষিদ্ধতা আরোপিত হয়ে যাবে।
এই সব হিজড়াদেরকে কেউ বিবাহ করলে অ’ত:পর তার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারলে তাদের বিবাহ সহিহ হবে। আবার এর বিপরীত কোনো হিজড়া কোনো নারীকে বিবাহ করে এবং তার সঙ্গে সঙ্গমে সক্ষম হলে তাদের বিবাহ বহাল থাকবে, অন্যথায় এই হিজড়া থেকে বিবাহসূত্র উঠিয়ে দেবে।
সাক্ষ্যদান ও বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রেও তাদেরকে একজন নারীর স্থলাভিষিক্ত করা হবে। একজন পুরুষের মুকাবিলায় যেমন এক দুইজন নারী, ঠিক তেমনি একজন পুরুষের মুকাবেলায় দুইজন প্রকৃত হিজড়ার হুকুম। এ ধরনের প্রকৃত হিজড়াদের ইন্তিকালের পর কোনো নারী-পুরুষ তাদেরকে গোসল দেবে না; বরং তায়াম্মুম করিয়ে দেবে। এক্ষেত্রে যে তায়াম্মুম করাবে সে যদি হিজড়ার মাহরাম না হয় তাহলে হাতে কোনো কাপড় পেঁচিয়ে নেবে। কারণ পুরুষের জন্য কোনো নারীকে এবং নারীর জন্য কোনো পুরুষকে গোসল দেয়া শরীয়তসম্মত নয়।
একজন মু’সলিম হিসেবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার জানাযার নামাজ পড়া হবে এবং তাকে নারীদের ন্যায় পাঁচ কাপড়ে কাফন পরানো হবে। কেননা সে যদি নারীদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো সুন্নাতসম্মত পন্থায় কাফন পরানো হলো। আর যদি পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলেও কোনো অ’সুবিধা নেই। কারণ পুরুষ তার জীবদ্দশায় তিনের অধিক কাপড়ও পরিধান করে। দাফনের সময় মাহরাম ব্যক্তিই তাকে কবরে নামাবে এবং চাদর ইত্যাদি দ্বারা তার কবরকে ঢেকে নেবে, এটা উত্তম এবং মু’স্তাহাব। কেননা, যদি সে প্রকৃতপক্ষে নারীর অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো তা ওয়াজিবের পর্যায়ভুক্ত। আর যদি সে পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে চাদর দ্বারা ঢাকার দরুণ কোনো সমস্যা হবে না। (কিতাবুল আসল লি ই’মাম মুহাম্মাদ ৯/৩২৩, কামু’সুল ফিকহ ৩/৩৭৯)
চলবে…
উপরোক্ত আলোচনা পর্যালোচনা ও তাদের বিধান বর্ণনা করার পর একথা বলতে পারি, ইস’লাম হিজড়াকে কোনো অংশেই অবহেলা করেনি। সকল ক্ষেত্রেই তাদের গন্য করেছে। তবে তারা সুস্থ নারী পুরুষের মতো না। একধরণের প্রতিবন্ধি। ইস’লাম সক্ষম ব্যক্তিকে অক্ষম ব্যক্তির স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে দায়িত্ব প্রদান করেছে। এর দ্বারা শুধুমাত্র সৃষ্টিজীবের প্রতিই মমতা প্রদর্শন হয় না। এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল এবং পরকালীন মহাসফলতা। সর্বোপরি রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য অর্জন। তাঁর সঙ্গে বান্দার তৈরি হয় সুস’ম্পর্কের সেতুবন্ধ; যা প্রতিটি মুমিন-মু’সলমানের জীবনের একমাত্র চাওয়া পাওয়া।
Leave a Comment