একজন ভারতীয় রেগে গ্যালে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায় (জাট বাদে), একজন পাকিস্তানী রেগে গ্যালে ভাঙচুর আর মারামারি শুরু করে দ্যায় কিন্তু একজন বাঙলাদেশী রেগে গ্যালে গালি দ্যায়!
লক্ষনীয় দিক হচ্ছে একজন বাঙলাদেশী মার খাওয়ার আগে ও পরে উভয়ক্ষেত্রেই গালি দ্যায়, এমনকি যদি গালি দেওয়ার কারণেই মার খায় (বহুক্ষেত্রে) তবুও! অনেকসময় ভয়ে সামনাসামনি না পারলেও, আক্রমণকারীর প্রস্থান হলে পর তাকে ঠিকই কষে দুচারটা গাল পাড়ে, এক্ষেত্রে বাঙলাদেশী দৃষ্টিভঙ্গীটা হচ্ছে- “হালারে মারতে পারিনাই ঠিকাসে, দুইটা গালি তো দিসি!” অর্থাৎ তাঁর শারীরিক বেদনা হ্রাস পেয়েছে তাঁর মনোপ্রসন্নতার কল্যাণে। ধ্যান বা যোগব্যায়ামের পর এহ্যানো আশু ফলাফল লাভ ক্যাবলমাত্র গালিতেই সম্ভব, ক্যাননা ধোলাইকৃত ব্যক্তিটির হিসাবে দশজনের সামনে মার খেয়ে তাঁর অহংয়ে যে আঘাতটা লেগেছিলো, গালির মাধ্যমে তা প্রশমিত হয়েছে!
প্রতিটি বাঙলাদেশীই গালি দ্যায়, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বিত্তবান, ভবঘুরে… বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের ভঙ্গিমা আর ভাষার টান ভিন্ন হলেও, শব্দ চয়নে খুব বেশী তফাৎও হয়না। মোটাদাগে গালিই বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক বৈশিষ্ট্য।
মনে রাখতে হবে যে একজন সাধারণ বাঙলাদেশী সুশিক্ষিত নয়, যে কিছু সনদ পেয়েছে সেও পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কিছুই পড়েনি বা পড়লেও মানোত্তীর্ণ ধরণের কিছু নয়, ফলশ্রুতিতে তাঁর চিন্তার গভীরতা কম এবং যুক্তি, তথ্য, বিশ্লেষণ বা দর্শনের অক্ষমতার হেতু গালিগালাজকেই নিজের অনুভুতি প্রকাশের মাধ্যম বানিয়ে ফ্যালে।
অতএব ঘটনাক্রমে আপনার জন্ম যদি এবঙ্গে তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল, ভালো লাগুক বা না, বাঙলাদেশে সামাজিক হতে চাইলে বা আর দশজন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না চাইলে গালি আপনাকে জানতেই হবে।
কিন্তু গালি জানার আগে গালির ফলিত প্রকৌশল জানাটা জরুরী। চিন্তিত হবার কারণই নেই, এ প্রবন্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই যে আপনাকে দেশী গালির গতিপ্রকৃতি সম্মন্ধে নাড়ির জ্ঞান সরবরাহ করা হবে।
গালি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বদা মনে রাখা জরুরী যে শুধুমাত্র কয়েকটা নোঙরা কথা বলাই গালি নয়, একজন ব্যক্তি রাগে দিশেহারা হয়ে অনেকগুলো “আচ্চাবাচ্চা” বলে ফেলতে পারে আবার অপর একজন গলার আওয়াজ একটুও না চড়িয়ে, শান্তভাবে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিত্বের ভিত নাড়িয়ে ফেলতে পারে, কারণ কাউকে গালি দেওয়ার অর্থ সরাসরি তার মনের উপর আঘাত করা, প্রথম অশালীন শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্র দুইজন ব্যক্তির মধ্যে একটি স্নায়ুর দ্বৈরথ শুরু হয়ে যায়।
গালি যেহেতু একজন ব্যক্তিকে দেওয়া হয় সেহেতু তার ব্যক্তিগত তথ্য বেশ জরুরী, আপনার লক্ষ্য সবসময় সেই জায়গাটা হওয়া উচিৎ যেখানে আঘাত করলে সবচেয়ে বেশী লাগে। ধরুন একজন সদ্য শত্রুতে পরিনত হওয়া পুরাতন বন্ধু যখন ঝগড়া করে, সে শুধুই কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করে না, আপনার নিজের জীবনের আয়নাটা আপনার সামনে তুলে ধরে, আর এধরণের আক্রমণের সামনে অধিকাংশ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। এর ফলে ব্যক্তিটি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বৈকি কিন্তু রণকৌশল হিসেবে এর কার্যকরিতা অস্বীকার করবার কোন উপায় নাই।
কিন্তু যাকে গালি দিচ্ছেন সর্বক্ষেত্রে সে আপনার জানাপরিচিতর মধ্যেই হবে এমনটা জরুরী নয়। যদিও সেটা মূলতঃ প্রতিবন্ধকতা নয় বরং সুযোগ, কারণ যেটা আপনি জানেননা সেটা আপনি খুব সহজে অনুমান করে নিতে পারেন। হয়তো ভাবছেন অনুমান! ঞ্যঁ?
চিন্তা করবেন না, দুনিয়ার শত শত আবহাওয়া দফতরে হাজার হাজার কর্মচারী লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করে নিচ্ছে শুধুমাত্র অনুমান করে, যার যথার্থতার কোন নিশ্চয়তা কখোনোই নেই আর শেয়ারবাজারে এই হিসাব কোটিতে! কিন্তু একজন অচেনা ব্যক্তির ব্যাপারে অনুমান সঠিক না হলে দ্বৈরথেও যদি পরাজয় নেমে আসে? ভাববেন না, লোক অচেনা হতে পারে, মানুষ নয়!
তো আমাদের রণকৌশল হবে এমন যে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীর সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটা খুঁজে বের করবো এবং সেখানেই পুনঃপুনশ্চ আঘাত করে তাকে পরাভূত করবো। সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটা বোঝার জন্য আমরা সম্ভাব্য কিছু জায়গায় আঘাত করবো, ঠিক যেই জায়গায় আঘাত করলে প্রতিদ্বন্দ্বী সবচেয়ে কঠোর আর শক্ত প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে হবে সবচেয়ে দূর্বল জায়গা ওটাই, বারবার আক্রমণ করুন, নিজেকে ধরে রাখবেন না। মনে রাখবেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি করলে তাতে ডুবে মরবার পুরো সম্ভাবনা আপনার নিজেরই। অতএব প্রথমতঃ কখনোই ঝগড়ায় জড়াবেন না আর যদি জড়িয়েই পড়েন তখন খোলা মন রাখুন, যতো হীন বা নীচই হোক, গালি দেওয়ার পূর্বে ভাববেন না। একবার তার দূর্বলতম জায়গা পেয়ে গ্যালে সামান্য কিছু আঘাতে সে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে, এরপর যতোবার সে উঠে দাঁড়াতে চাইবে, ঘুরে ফিরে ওখানেই আঘাত করুন, প্রতিবার আগের চেয়েও হীন আর আগ্রাসী ভাবে। এটা স্নায়ুযুদ্ধ, আপনার সৃষ্টিশীলতা আর ক্রোধকে বশ করবার ক্ষমতা আপনাকে বিজয়ী করবেই।
অতএব প্রথম ধাপ, সম্ভাব্য দূর্বল জায়গাটি কি করে খুঁজে পাবো? আমরা এক এক করে কয়েকটি জায়গায় আঘাত করবো এবং লক্ষ্য রাখবো সবচেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া আসছে কোথা থেকে? আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীটি যদি একজন বাঙলাদেশী বা উপমহাদেশীয় লোক হয়… বারবার ব্যক্তির বদলে লোক বলছি, ক্যাননা গালি আপনি শুধুমাত্র একজন পুরুষকেই দেবেন, একজন নারী বা মেয়েকে কখনোই না, কোন ক্ষেত্রেই না, ঘটনা বা পারিপার্শ্বিক যাই হোক না ক্যানো। একারণে না যে আপনাকে ভদ্রলোক হতে বলছি, বরং একারণে যে একজন নারীকে হারাতে নয়, জয় করতে শিখুন।
তো আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতবর্ষের যেকোন প্রান্তের লোক হোক না ক্যানো, কোয়েটা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মানুষের দূর্বলতা একটাই, যে তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হয়েছে আর পুরুষতন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি? – নারী! অতএব প্রতিটা ক্ষেত্রে আপনার গালির শুরু হওয়া উচিৎ নারীর সম্পর্ক ধরে। বিভ্রান্ত হবেন না নারীকে গালি না দিলেও নারী বিষয়ক গালি চলে, একজন বাঙলাদেশী হিসাবে এটা আপনার কপালের ফের।
প্রাথমিক ভাবে বোনের গালি দিয়ে দেখতে পারেন। বোন সংক্রান্ত গালির প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে এতে মানুষ খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারায়, এমনকি যার ইহজন্মে কোন বোন ছিলোনা সেও! পুরুষতন্ত্রে মানুষ নিজেকে নারীর রক্ষাকারী হিসেবে ধরে ন্যায়, সেই সাথে পরিবারের সমস্ত নারীকে নিজের অধিনস্তও।
অনেকক্ষেত্রে বোনের গালির ঝাঁঝ খুব বেশী হলেও আস্তেধীরে কেটে যায়, বিশেষ করে লোকটির সত্যিই যদি কোন বোন না থেকে থাকে, তো এবার আপনার পরবর্তী লক্ষ হওয়া উচিৎ বাঙালী পুরুষের সবচেয়ে প্রিয় আর পবিত্র বন্ধন- মা! মায়ের গালিতে চুপ থাকবে এমন পুরুষ বাঙলাদেশে ক্ষণজন্মা! আর যদি কেউ তাস্বত্বেও আহত না হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে লোকটি আসলেই খুব নিম্নমানের, এক্ষেত্রে আরেকটু কড়া দাওয়াই জরুরী। মনে আছেতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ? বেয়াদবটাকে বাপের গালি দিয়ে দেখুন!
এটা আগে কখনো করে দেখেছেন কি? অনেক পরিবারে মেয়েদের অত্যন্ত নীচু চোখে দ্যাখা হয়, অনেকক্ষেত্রে পরিবার প্রধান নিজেই সারাক্ষণ বাড়ির মেয়েদের অত্যন্ত খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে থাকেন, এমন ঘরের ছেলেরা মা কিম্বা বোনের গালিতে বিচলিত হবে না কিন্তু এসব পরিবারে বাবাকে ইশ্বরের পর্যায়ে মানা হয়, বাপের গালি দিন, ইশ্বরকে পড়তে দেখলে নেহায়েত শান্ত বান্দাটিও রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে আর শিকার করবার জন্য সবচেয়ে আদর্শ সময় ঠিক যখন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
কখনো কখনো এমন লোকের সাথেও সাক্ষাৎ হতে পারে যার ব্যক্তিগত গালিতে কোন ভ্রুক্ষেপ হয়না। উল্টে আপনাকেই পুরো নাজেহাল করে দেবে। আপনার হীন এবং নীচতম গালিতেও সে প্রতিক্রিয়াহীন, অথচ কিছু কথা শোনানো খুব জরুরী হয়ে উঠেছে। আপনি অসহায় হয়ে ভাবছেন কি লোকরে বাবা! চিন্তার কিছু নাই, যখন মানুষকে মারা যায় না তখন তার আদর্শকে মারতে হয়। যদি ব্যক্তিটির ঠিকানা বাঙলাদেশ হয়ে থাকে তবে সে উপায়হীন, কোন না কোন রাজনৈতিক দল অবশ্যই সমর্থন করে, আম্লীগ? বিম্পী? জামাত? গালি দিয়ে দেখুন, আগুন জ্বলে যাবে!
খাবারের সাথে সাথে য্যামন সালাদ জরুরী, ঠিক ত্যামনি দূর্বলতম স্থানে আঘাতের পাশাপাশি তার একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়েও আঘাত করুন। পুরো দুনিয়ায় একজন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় কে? সে নিজে! অতএব প্রতিপক্ষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক/সামাজিক অবস্থানকে আক্রমনের লক্ষ্য বানান। নিজের শালীনতাবোধকে নিজের দূর্বলতা হয়ে উঠতে দেবেন না।
ধাপগুলো গুরুত্বের সাথে মনে রাখুন, আগেরটা পরে, পরেরটা আগে করবেন না আর বিনা দ্বিধায় গালি দিতে থাকুন, একজন প্রকৃত বাঙলাদেশী হয়ে উঠবার আপনার অগ্রযাত্রায় শুভ কামনা রইলো।
ভাঙগাড়ি! #### #!!