ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন হত্যা মামলায় দুই আসামি ও গৃহকর্মী রিতা আক্তার ওরফে স্বপনা ও রুমা ওরফে রেশমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রবিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
একইসঙ্গে ৩৮১ ধারায় তাদের প্রত্যেককে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ মামলার দুই আসামিকে ১০ টার দিকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। এসময় তাদেরকে কারাগারের গারদে রাখা হয়। পরে দুপুর ১২ টা ৩৭ মিনিটে এজলাসে তোলা হয়। এরপর বেলা ১ টায় বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়া শেষ ১ টা ৫২ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন।
এদিকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ রায়ের জন্য আজকের এ দিন ধার্য করেন। এর আগে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনে এ মামলার দুই আসামি গৃহকর্মী রিতা আক্তার ওরফে স্বপনা ও রুমা ওরফে রেশমার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রত্যাশা করেন।
অন্যদিকে আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপনে আইনজীবীরা আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস প্রার্থনা করেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। পরে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর এ হত্যা মামলায় দুই গৃহকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউ মার্কেট থানার এসআই আলমগীর হোসেন মজুমদার সাক্ষ্য দেন। যার মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। মামলাটিতে মোট ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেন আদালত।
২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানী এলিফেন্ট রোডের নিজ বাসায় খুন হন মাহফুজা চৌধুরী। পরের দিন ১১ ফেব্রুয়ারী এ ঘটনায় নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা নিউ মার্কেট থানায় মামলা দায়ের করেন। গৃহকর্মী রিতা আক্তার ওরফে স্বপনা ও রুমা ওরফে রেশমা এবং দুই গৃহকর্মীর যোগানদাতা রুনু বেগমকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেয় পুলিশ। স্বপনা এবং রেশমা হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।
২০১৯ সালের ২১ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউ মার্কেট থানার এসআই আলমগীর হোসেন মজুমদার দুই গৃহকর্মীকে আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। রুনু বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি দুই আসামির বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
মাহফুজা চৌধুরী ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে ধানমন্ডির সুকন্যা টাওয়ারের ডুপ্লেক্স বাসায় থাকতেন। ডুপ্লেক্স বাসার ১৫/সি নম্বর ফ্ল্যাটে রান্না হতো এবং গৃহকর্মীরা থাকত।
গত বছরের ১১ জানুয়ারি রাশিদা বেগম ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এর আগে ৪ জানুয়ারি ওই বাসায় কাজে যোগ দেয় রুমা ওরফে রেশমা। রিতা আক্তার ওরফে স্বপ্না প্রকৃত ঠিকানা গোপন করে ২ ফেব্রুয়ারি গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী ইসমত কাদির গামা ব্যবসার কাজে বাসার বাইরে যান। এ সময় মাহফুজা চৌধুরীকে হত্যা করে টাকা চুরির পরিকল্পনা করে রুমা ও রিতা।
তারপর ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ইসমত কাদির গামা প্রতিদিনের মতো ব্যবসার কাজে বাসার বাইরে যান। দুপুরে রান্না শেষে ১৬/সি ফ্ল্যাটে মাহফুজা চৌধুরীকে খাবার দেয় রুমা। খাওয়া শেষে মাহফুজা চৌধুরী তার কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রুমা, রিতা, রাশিদা বেগম গোসল শেষে খাওয়া-দাওয়া করে। রাশিদা পানি গরম করার জন্য চুলায় পাতিল বসিয়ে দেয়। তখন রুমা ও রিতা রাশিদাকে বলে, তুমি ঘুমাও। রাশিদা গৃহকর্মীদের কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই সুযোগে রুমা ১৬/ সি ফ্ল্যাটের মূল ফটকের লক ও ছিটকিনি ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়।
রুমা ও রিতা বিকেল ৪টার দিকে মাহফুজা চৌধুরীর রুমে যায়। রিতা মাহফুজা চৌধুরীর হাত-পা চেপে ধরে। রুমা মাহফুজা চৌধুরীর গলায় থাকা ওড়না দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে বালিশচাপা দেয়। মাহফুজা চৌধুরী বাঁচার জন্য প্রতিরোধ করতে চাইলে তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত খাটের নিচে ঝুলে পড়ে। ঠোঁটে আঘাত লেগে রক্ত বের হয়। ৫-৭ মিনিট পর তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে আসামিরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
মাহফুজা চৌধুরীর বালিশের নিচ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খোলে রুমা। তারা টাকা, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য মালামাল চুরি করে কয়েকটি জুয়েলারির পার্স ও ব্যাগ মাহফুজা চৌধুরীর শয়নকক্ষ ও মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ফেলে রেখে বোরকা পড়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
বাসার নিরাপত্তাকর্মী জিজ্ঞেস করলে, রুমা ও রিতা জানায়, তারা ১৬/সি ফ্ল্যাটে আর্মির (মাহফুজা চৌধুরীর ছেলে) বাসায় কাজ করে। টেইলার্সে যাওয়ার কথা বলে তারা বের হয়ে যায়। তারপর প্রিয়াঙ্গন মার্কেটের সামনে থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে গাবতলীতে যায় রুমা ও রিতা।
রিতা বাসযোগে তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মদন থানাধীন ফতেহপুর গ্রামে এবং রুমা রাজধানীর কাফরুলের পূর্ব বাইটেকিতে মায়ের ভাড়া বাসায় চলে যায়।