বিভাগ জাতীয়

আমার ছেলে বাস্তবের একজন নায়ক ছিল: সিনহার মা

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের (৩৬) মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার। তাঁরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও নিজ দেশে সিনহাকে এভাবে মারা যেতে হবে, তা তাঁরা কখনোই ভাবেননি।

মেজর (অব.) সিনহার মা তাঁর ছেলের ব্যাচমেটদের জানিয়েছেন, কক্সবাজার থেকে পুলিশ তাঁকে ফোন করে তাঁর ছেলে সম্পর্কে বিভিন্ন খোঁজখবর নিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংবাদ তাঁকে জানানো হয়নি।

মেজর (অব.) রাশেদ খান সিনহার মা নাসিমা আখতার বলেন, আমার ছেলে বাস্তবের একজন নায়ক ছিল, সে সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করেছে, সে কোনো কাপুরুষ ছিল না, সে একজন জাতীয় বীর ছিল। সে ছিল একজন সত্যিকারের প্রেরণাদাতা, আমাদের সব আত্মীয়, সব বন্ধু তার কাছ থেকে জীবনের উৎসাহ পেত। সে সব সময়ই হাস্যোজ্জ্বল এক চমৎকার মানুষ ছিল, যে সব সময়ই মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অন্যদের সুখী করতে চেষ্টা চালাত। অপরের সুখের জন্য জীবন উৎসর্গ করাই ছিল তাঁর অন্যতম ব্রত।

চাকরির কারণে তাঁর পোস্টিং যেখানেই হোক না কেন, আমি যাতে ভালো থাকি, আরামে থাকি তা নিয়ে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। বাড়ির প্রতিটা কাজে আমাকে সাহায্য করত। সব কাজ সব সময়ই নিজে নিজেই করে আমাকে সব সময় চমকে দেওয়ার কাজটা সে খুব ভালো পারত। আমাদের বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেয়াল সে নিজের হাতে সাজিয়েছিল।

কিন্তু যখন সে এসএসএফে পোস্টিং পেল (তাঁর ১৬ বছরের সামরিক জীবনে যে একটি মাত্র সময়ই সে ঢাকায় পোস্টিং পেয়েছিল), তখনই যে হাউজ বিল্ডিং থেকে ঋণ নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের বাড়িটা চারতলা করে। এই নির্মাণকাজের তদারকি করার জন্য সে অধিকাংশ সময়ই সে রাতে আসত, যেহেতু এসএসএফের দায়িত্বে ব্যস্ততা অত্যন্ত বেশি থাকায় রাত ছাড়া সময় পেত না।

আমার ছেলেকে তার কোনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি আটকে রাখিনি, কোনো সময়ই না। যা যা সে করতে চেয়েছে, আমি স্বাধীনতা দিয়েছি। অবশ্য সে আমাকে সব সময়ই বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হতো কোনো না কোনোভাবে। আমাকে না বুঝিয়ে সে একটা কাজও করেনি। সে সব সময়ই আমার অনুমতি নিয়ে নিত সেই কাজগুলোর জন্য, যেগুলো তাকে সুখী করতে পারে। যাতে তার ভালো লাগে, সেই কাজগুলোতে আমার সব সময়ই সায় ছিল।

দেশকে যে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। আমার ছেলে ছিল দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে সমুদ্র ভালোবাসত, সে সৈকতে  বই পড়তে পড়তে সময় কাটাতে চাইত। শৈশব থেকেই সে অ্যাডভেঞ্চারের ভক্ত ছিল। সারা বিশ্ব ভ্রমণের এক প্রগাঢ় সাধ ছিল তার, যে জন্য বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী থেকে সে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিল। আমি তাকে নিষেধ করিনি। তার হিমালয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল, ছেলেটা হাইকিং পছন্দ করত, জাপানে একটা সাইকেল ট্যুরে যেতে চেয়েছিল। চাকরি থেকে অবসরের পরপরই সে তাঁর এই স্বপ্নগুলো ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
  
এর মাঝে করোনা মহামারি চলে এলো। দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার ক’দিন পর সে জানাল যে তাকে নিয়মিতই বাইরে যাতায়াত করতে হয়, এবং আমি একজন বয়স্ক মানুষ, তাই তার এই চলাফেরা আমার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এরপর সে বলল যে রাজশাহী যাবে কিছুদিনের জন্য, সেখানে তাঁর এক বন্ধুর মা (যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন) এক বিশাল লাইব্রেরি করেছেন। ছোট থেকেই সে প্রচুর বই পড়ত। তাই তাকে আমি সেখানে যেতে দিলাম, বললাম প্রচুর পড়াশোনা করতে। সে রাজশাহীতে প্রায় চার মাস ছিল এবং আস্তে আস্তে নিজেকে বিশ্ব ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত করছিল। 

ছেলেটার তীব্র ভ্রমণের নেশা ছিল। যখন সে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে ছিল, ছুটিতে বাংলাদেশে আসত না। তার বদলে দুই মাসের ছুটিতে ইউরোপ গিয়ে গাড়িতে করে হাজার হাজার মাইল ড্রাইভ করে নিজে নিজে ঘুরেছিল। এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল কারণ ছেলেটা অন্তত নিজের একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিল। আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সিদ্ধান্তের প্রতি।

আমার সব ওষুধপত্র নিজে নিজেই সাজিয়েগুছিয়ে রাখত, যাতে আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়। যখনই বাড়ির বাইরে যেত, সব সময়ই নিজের চাবি নিয়ে যেত, যাতে আমাকে বিরক্ত না করতে হয় দরজা খোলার জন্য।
রাজশাহী থেকে ফিরে মাত্র কদিন আমার সঙ্গে ছিল। এবং তারপর কক্সবাজারে এক মাসের জন্য থেকে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা জানাল। আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। সে বিয়ে করেনি, আর আমিও তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। ২৬ জুলাই ছিল ওর জন্মদিন। অনলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে সে যে রিসোর্টে ছিল, সেখানে এক বাক্স চকোলেট পাঠিয়েছিলাম।  কোরবানির ঈদের সময় ছেলেটা আমাকে কক্সবাজারে গিয়ে ওর সঙ্গে ঈদ করতে বলছিল, কারণ তথ্যচিত্রের শুটিংয়ে নাকি আরো কয়েক দিন সময়ের দরকার ছিল। অসুস্থতার কারণে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আমার ছেলে একজন শহীদ। একজন বীরের রক্ত এবং মায়ের অশ্রু বৃথা যেতে পারে না। আশা করি পরম করুণাময় তাকে জান্নাতে আশ্রয় দেবেন।

ঈদের আগের রাতে পুলিশ ফোন দিলেও মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু সংবাদ জানায়নি। মেজর (অব.) সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের দিন সকাল ১১টার দিকে উত্তরা থানা থেকে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আমাদের বাসায় আসেন। তাঁরা এসে আমার ভাই সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করেন। তাঁরা ঘরে থাকা ছবিগুলোও দেখেন। তাঁরা কনফার্ম হতে চেয়েছিলেন আমার ভাই আর্মিতে ছিল কি না। তাঁরা ছবিও তুলে নিয়ে যান।

পুলিশ সদস্যরা আমার ভাই সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলেও একটিবারের জন্য বলেনি যে সে আর নেই।

আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ আনা হয়েছে; কিন্তু আমার ভাই তো জীবনে একটা সিগারেট পর্যন্ত খায়নি।

পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। সোমবার তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা

ঢাকা, ২৪ আগস্ট ২০২৫: পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. ফাইজুর…

August 24, 2025

বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া সভাপতি ফারুকের প্রায় ১২০ কোটি টাকা ট্রান্সফার!

বিসিবির ফিক্সড ডিপোজিট নিয়ে বিশাল আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে! ক্রিকেট বোর্ডের…

April 24, 2025

২০০৯ এর বিডিআর বিদ্রোহ এবং ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি

"২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় প্যারাশুট রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সান্ধু সেদিন "স্পিয়ারহেড"…

February 26, 2025

কি ঘটেছিলো বিডিআর বিদ্রোহে! নেপথ্য কাহিনি

আলোচিত বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনি আজও অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরেও সেই রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের…

December 29, 2024

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024
Sponsored