করোনাভাইরাসের ডেলটা ধরনের বিস্তার ঠেকাতে সোমবার (২৮ জুন) থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউন’ জারির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ খবর শুনে গতকাল থেকে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ।
অনেকটা ঈদযাত্রার মতো দলে দলে গ্রামে ছুটছে মানুষ। নগরীর প্রবেশমুখ ও বাহিরের অন্যতম সড়ক গাবতলী এলাকা, ঢাকা-মাওয়া রোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে, উত্তরার আব্দুল্লাপুরে ছিল মানুষের ঢল।
দূরপাল্লার বাস না পেয়ে পিকআপ, মোটরসাইকেল বা বিভিন্ন ছোট বাহনে রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছেন মানুষ। অনেকে হেঁটেই রওনা হয়েছেন বাড়ির পানে। মানুষের ঘরে ফেরা বন্ধে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে চেকপোস্ট বসানো হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না ঘরমুখো মানুষের স্রোত। যে যেভাবে পারছেন মরিয়া হয়ে ছুটছেন গ্রামের পথে।
রাজধানীর প্রবেশমুখ ও বাহিরের অন্যতম সড়ক গাবতলী এলাকা, ঢাকা-মাওয়া রোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে, উত্তরার আব্দুল্লাপুরে নেমেছে ঘরমুখো মানুষের ঢল। বাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন যানবাহনে কয়েক ধাপে, কয়েক গুণ ভাড়া বেশি দিয়ে গন্তব্যে ছুটছেন মানুষ। মাইক্রোবাস কিংবা ছোট বাহনে চেপে বসা এসব মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই।
সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাড়িকে ঢাকায় ঢুকতে বা বের হতে না দিলেও কিভাবে ঢাকা ছাড়ছে এতো মানুষ? জবাব পাওয়া গেল গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত চলাচল করা রেন্ট-এ-কারের মালিক সুমনের কাছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, মানিকগঞ্জে লকডাউন চলছে।
পুলিশের চেকপোস্টও আছে। তবে এসব চেকপোস্ট শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যেতে বেশ কয়েকটি বিকল্প গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। আমরা শহর এড়িয়ে এসব গ্রামীণ সড়ক ধরে চলাচল করছি।
গাবতলী এলাকার একটি ফিলিংস্টেশনে সুমনের প্রাইভেট কারে তিনজন যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা গেছে। আরো দুজন যাত্রী খুঁজছিলেন সুমন। কারে বসে থাকা একজন যাত্রী জানালেন তাঁর নাম আবুল কালাম। মুগদায় থাকেন। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। আবুল কালাম আরো জানান, ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যাচ্ছেন তিনি।
গাবতলীতে দেখা গেল রোমেজা খাতুন নামে এক নারী কাঁধে বস্তা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আমিনবাজারের দিকে। সঙ্গে আনুমানিক ১০ বছর এবং তারো কম বয়সী আরেক কিশোর। তাদের মাথায়ও ব্যাগ। রোমেজা জানান, দুই কিশোরের মধ্যে একজন তাঁর ছেলে, আরেকজন ভাগ্নে। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া যাবে তারা। বাস বন্ধ, কিভাবে যাবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রোমেজা খাতুন বলেন, কত মানুষ যাচ্ছে! সামনে গেলে একটা গতি হয়েই যাবে। কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।
গাবতলী থেকে আমিনবাজারমুখী জনস্রোতের বেশির ভাগের মুখে মাস্ক নেই। মাস্ক ছাড়া চলাচল করা মানুষের ব্যাপারে কোনো তদারকিও চোখে পড়েনি। মিরপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের মুখে মাস্ক নেই কেন? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কিছু বলছেন না? এঁদের প্রায় সবার কাছ থেকে না সূচক জবাব পাওয়া গেছে।
সাত জেলায় লকডাউন ঘোষণার প্রথম দিনে লোকজন ও যান চলাচল কিছুটা কম থাকলেও গতকাল দেখা গেছে অন্য চিত্র। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে যাত্রী পরিবহন ক্রমেই বাড়ছে।
আশপাশের জেলা থেকে রাজধানীতে মানুষের প্রবেশ যেমন অব্যাহত আছে, একইভাবে রাজধানী ছেড়েও যাচ্ছে মানুষ। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও মাইক্রোবাসে যাত্রী বহনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। যাত্রীদেরও হাঁকডাক করতে দেখা গেছে। অনেকে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ ছোট ছোট যানে যাতায়াত করছে। এসব যাত্রীরা জানায়, জরুরি প্রয়োজনেই তারা যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে।
গোলাম নবী যাবেন সিলেটে। যাত্রাবাড়ি থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত এসেছেন মোটরসাইকেলে। এখন খুঁজছেন বিকল্প পথ ও যান। তিনি বলেন, জরুরি কাজে বাড়ি যেতে হবে। কিন্তু টার্মিনালে এসে যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে মনে হলো অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। উপায় নেই, যেতেই হবে। বাস বন্ধ থাকায় মাইক্রোচালকরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করছেন।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এক মাইক্রোবাসচালককে দেখা গেল কুমিল্লার যাত্রী ডাকতে। জনপ্রতি ৮০০ টাকা ভাড়ায় কুমিল্লার যাত্রী তোলা হচ্ছিল।
সড়কের মতো একই অবস্থা দেখা গেছে নৌপথেও। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে লোকজন ছুটছে দক্ষিণবঙ্গের উদ্দেশে। সড়কে যানবাহনের সংকট থাকায় ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলে তারা যাচ্ছে শিমুলিয়া ঘাটের উদ্দেশে। নৌপথেও নৌযান সংকট দেখা গেছে। লৌহজং ও শ্রীনগরের কয়েকটি স্পট থেকে যাত্রীরা মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা নদী পার হচ্ছে এসব ট্রলারে করে।
বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাট সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহমেদ বলেন, শিমুলিয়া ঘাটে এখন ১৪টি ফেরি সচল রয়েছে।
লকডাউনের নিয়ম অনুযায়ী ফেরিতে শুধু রোগী বহনকারী গাড়ি এবং জরুরি পণ্য পরিবহণের গাড়ি ছাড়া সবকিছু পারাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঘাটে ভিড় জমাচ্ছেন যাত্রীরা।