দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হলেও এর গভীরতা সাড়ে ৯ মিটারের বেশি বাড়ানো যায়নি। বর্ধিষ্ণু আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকে মসৃণ করতে গভীর সমুদ্র বন্দরের চাহিদা তাই দীর্ঘদিনের। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে উদ্যোগ চলছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের। মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দর নিমাণ প্রকল্পটি সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাশও হয়েছে।
মাতারবাড়ী চ্যানেলের গভীরতা ১৬ মিটার। এশিয়ার ব্যস্ততম দুই সমুদ্রবন্দর সাংহাই ও সিঙ্গাপুরের চেয়ে বেশি এ গভীরতা। পরবর্তীতে এ গভীরতা খনন করে সাড়ে ১৮ মিটার করা হবে। সেটা হলে মাতারবাড়ী হবে যৌথভাবে এশিয়ার গভীরতম সমুদ্রবন্দর। বর্তমানে এশিয়ায় সাড়ে ১৮ মিটার গভীরতা আছে কেবল ভারতের কৃষ্ণপতœম সমুদ্র বন্দরের। এর কাছাকাছি অর্থাৎ ১৮ মিটার গভীরতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে শ্রীলংকার কলম্বো গভীর সমুদ্র বন্দর।
এশিয়ার অন্য গভীর সমুদ্র বন্দরগুলোর মধ্যে চীনের সাংহাইয়ের গভীরতা ১৪ দশমিক ২ ও সিঙ্গাপুরের ১৫ দশমিক ৭ মিটার। এছাড়া ভারতের বিশাখাপতœম সমুদ্র বন্দরের গভীরতা ১৭, চেন্নাইয়ের ১৬ দশমিক ৫, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার ১৪ দশমিক ৫ জাপানের কোবের ১৩ এবং হংকং সমুদ্র বন্দরের গভীরতা ১৫ মিটার। বিশ্বের গভীরতম সমুদ্র বন্দরটি অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনি হারবারের গভীরতা ৪৫ মিটার। দ্বিতীয় গভীরতম যুক্তরাষ্টের মাহোন বন্দরের গভীরতাও মিটার।
মাতারবাড়ী যেসব সুবিধা দেবে বাংলাদেশকে
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। দেশটির এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণ কম সময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছে তারা। এ কারণে দেশটি ক্রয়াদেশও বেশি পাচ্ছে। উৎপাদন ক্ষমতারও সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারছে।
দুর্বল অবকাঠামোর পাশাপাশি কম সময়ে বাংলাদেশের পণ্য পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা চট্টগ্রাম বন্দর। পণ্য উঠানো-নামানোয় প্রচুর সময় নষ্ট হয় এখানে। এর কারণ মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের স্বল্প ড্রাফট বা গভীরতা। দেশের প্রধান এ সমুদ্র বন্দরে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে কোনো মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ নেই। এ কারণে মাদার ভেসেলকে প্রথমে বহির্নোঙরে অপেক্ষা করতে হয়। বন্দর থেকে ফিডার ভেসেল রওনা করে মাদার ভেসেলের কাছে পৌঁছায়। এরপর মাদার ভেসেল থেকে পণ্য ফিডার ভেসেলে তোলা হয়। এরপর সেই ফিডার ভেসেল আবার বন্দরে এসে সেটা খালাস করে।
রফতানির ক্ষেত্রে সরাসরি মাদার ভেসেলে পণ্য উঠানো সম্ভব না হওয়ায় সিঙ্গাপুর বন্দরে মাদার ভেসেল বুকিং দেয়া হয়। এরপর সেখানে গিয়ে পণ্য মাদার ভেসেলে তোলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় রফতানিতে প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
দুর্বল অবকাঠামোর কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ২ হাজার টিইইউএস বাহী জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ীর গভীরতা বেশি হওয়ার ফলে সেখানে ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে।
চট্টগ্রাম ৪ হাজার কনটেইনার বহন করতে সাধারণ ৬-৭টি জাহাজ লাগে। এ বন্দরে প্রতিদিন কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টিইইউএস। কিন্তু মাতারবাড়ীতে এক জাহাজেই ৮ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডল করা যাবে। এতে খরচ কমবে, সময়ও বাঁচবে। রফতানি প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনামের সঙ্গে পিছিয়ে পড়াটা পুষিয়ে নেয়া যাবে।
অপেক্ষা আরো ৬ বছরের
এসব সুবিধা অবশ্য এখনই মিলছে না। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো অন্তত ৬ বছর। জাপানের সহায়তা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ হিসেবে দেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার জোগান দেবে ২ হাজার ৬৭১ কোটি এবং এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ২১৪ কোটি টাকা সরবরাহ করবে।
বন্দরটি নির্মিত হবে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (দি বিগ-বি)’ শীর্ষক উদ্যোগের আওতায়। জাপানের কাশিমা ও নিগাতা (পূর্ব) নামের দুটি বন্দরের আদলে নির্মাণ করা হবে দেশের প্রথম এ গভীর সমুদ্রবন্দর। এতে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। এই টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে যথাক্রমে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার।
প্রকল্পটির অন্যান্য অঙ্গের মধ্যে রয়েছে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেনবিশিষ্ট সড়ক এবং ১৭টি সেতু নির্মাণ। এ ১৭টি সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার।
সড়কপথে পণ্য পরিবহনে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া হয়ে মাতারবাড়ী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে এবং এ সড়ক যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। এছাড়া রেলপথ বিভাগের চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে।
এ প্রকল্পে আরো যা থাকছে তার মধ্যে আছে দুটি কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, একটি মাল্টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, ৬টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন, দুটি রিচ স্ট্যাকার, ট্রাক্টর চেসিস, তিনটি টাগবোট, একটি পাইলট বোট ও একটি সার্ভে বোট। ২০২৬ সালে একটি মাল্টিপারপাস জেটি ও একটি কনটেইনার জেটি চালুর মধ্য দিয়ে এ গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হবে।
বর্তমানে বছরে ৩০ লাখ টিইইউএস (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডেল হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ১ কোটি ২৫ লাখ টিইইউএসে উন্নীত হবে। সেই কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর।