কবি সুফিয়া কামাল তিনি বাঙালি জাতির বিবেক, জননী সাহসিকা, অকুতোভয় সংগ্রামী, মানবতার কবি। দেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত, প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের এই স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম কবি সুফিয়া কামালের ১০৯তম জন্মদিন আজ ২০ জুন। জননী সাহসিকা হিসেবে খ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
এই মহীয়সী নারী আজীবন মুক্তবুদ্ধির চর্চার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে সংগ্রাম করেছেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মারা যান।
বহু গুণে, বহু বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এই মানবতাবাদী লেখকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৫ সালে। তার আগে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের কাছ থেকে জানতে পেরে চমকিত হই তাঁর প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলা হিসেবে বিমানে উড্ডয়ন করে ইতিহাস সৃষ্টি করার অভিজ্ঞতা শুনে। মাথায় হেলমেট, কানে হেডফোন ও চোখে গগলস পরে বিমানের একজন পুরুষ পাইলটের সঙ্গে ভূমি থেকে তিন হাজার ফুট ওপরে ওঠার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। সেই অবরুদ্ধ সমাজে শুধু তা-ই নয়, সেই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা পরের সংখ্যা সওগাতে প্রকাশ করে নন্দিত হয়েছিলেন। আরো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বেগম রোকেয়া সেই সময়ে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের ম্যাট্রিকুলেশন পাস এবং সুফিয়া কামালের বিমান ভ্রমণের সাহসিকতার জন্য এক ঘরোয়া সংবর্ধনা দিয়েছিলেন তাঁদের।শুধু তা-ই নয়, খানদানি উর্দুভাষী পরিবারের মেয়ে হয়েও সেই সময়ে সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে টুপি, আচকান, পায়জামা পরে পেয়ারী লাল মাস্টারের কাছে পড়তে যাওয়া, সবার অগোচরে কবিতা লিখে পত্রিকায় প্রকাশ করা, বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের মেয়ে সাবিত্রী দেবী প্রতিষ্ঠিত মাতৃমঙ্গল সমিতিতে একমাত্র মুসলমান সদস্য হিসেবে কাজ করা। ১৯২৫ সালে বরিশালে মহাত্মা গান্ধী এলে খাদি পরে প্রকাশ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করা এবং নিজ হাতে কাটা চরকার সুতা তাঁর হাতে তুলে দেওয়া, সওগাত সম্পাদকের সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়ে পুরুষ ফটোগ্রাফারের হাত থেকে ছবি তুলে লেখক হিসেবে সেই ছবি মহিলা সওগাতের প্রথম সংখ্যায় ছাপার সম্মতি দেওয়া, রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে স্বামী নেহাল হোসেনের সঙ্গে ঠাকুরবাড়িতে নাটক দেখতে যাওয়া অথবা গড়ের মাঠে কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন এবং সওগাত সম্পাদকের স্ত্রীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মতো প্রতিবাদী ও সাহসী ঘটনাগুলো নারীমুক্তি ও সমাজ প্রগতির ধারাকে সেই সময় যে কতখানি বেগবান করেছিল সেই তাত্পর্য আজ আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি।
সুফিয়া কামাল আলোকবর্তিকা হিসেবে পথের দিশা দেখিয়েছেন। তিনি যেমন দেশের শিশুদের দেশপ্রেমিক, সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সারা জীবন একান্তভাবে কাজ করেছেন, তেমনি চোখ রেখেছেন নারীসমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যেও। প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ। মহিলা পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার কারণে আমি তাঁর আন্তরিক চেষ্টা, একাগ্রতা খুব কাছে থেকে দেখেছি। প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী হিসেবে আজীবন লড়েছেন এ দেশের সুযোগ ও অধিকারবঞ্চিত অসহায় নির্যাতিত নারীসমাজের জন্য। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী নারী আন্দোলন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর আজীবনের সংগ্রাম অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ ফ্যামিলি কোডের জন্য যে আন্দোলন তার পেছনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা এই আন্দোলনে গতি ও প্রাণ সঞ্চার করেছে, একে আরো বেগবান করেছে। বেগম রোকেয়ার মতো তিনি তাঁর সব কাজ পরিচালনা করেছেন মুক্তবুদ্ধি প্রসারের জন্য। অন্ধ, কুসংস্কার ও চিন্তার ক্ষেত্রে সমাজের কূপমণ্ডূকতা দূর করে উদার ও যুক্তিপূর্ণ সমাজ ও মানবজীবন প্রতিষ্ঠার জন্য, নিরলস সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি নিরন্তর সমাজ ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সহযাত্রী অন্য নারীদের সঙ্গে আঁচলের আড়ালে একেকটি করে ইট লুকিয়ে নিয়ে হেঁটে গেছেন শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। সে সময় তিনি গর্ভবতী ছিলেন।
এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, অসাম্প্রদায়িকতার প্রসারে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের নিরন্তর নির্ভীক কর্মপ্রয়াসে ও চিত্তের গভীর দীপ্তিতে তিনি সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। দেশের সব প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজ ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসকদের বৈরিতার মুখে ১৯৬১ সালে বরীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি গঠিত হয়, যার কেন্দ্রে ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। আজ তিনি নেই, অথচ এই দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে যখনই অশুভচক্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, ষড়যন্ত্র হয়েছে, আমরা মুখ তুলে তাকিয়েছি তাঁর দিকে, নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। আজ তিনি নেই কিন্তু সেই গভীর সত্য উপলব্ধি করে আজও আমরা উদ্দীপ্ত হই।
এক অবরুদ্ধ অজ্ঞ কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে প্রগতিবিমুখ এক সমাজের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে সাহিত্যচর্চা ও জাতির সব বৃহত্তর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে যিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সমাজকর্মে উজ্জীবিত হয়েছেন মহীয়সী বেগম রোকেয়ার প্রত্যক্ষ প্রেরণা থেকে। তাঁর সংগ্রাম শুধু নারী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনবিরোধী আন্দোলনে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি হয়েছেন শতাব্দীর সাহসিকা, মানবকল্যাণ ও প্রগতির প্রতীক। কবিতার সুকোমল জগতে ছন্দ-মিল চিত্রকল্পের মধ্যে থেকেও তিনি নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কথা ভোলেননি। তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে নেমে এসেছেন রাজপথে। মৌলবাদীদের হুমকি, তিরস্কার উপেক্ষা করে নিজ আদর্শে থেকেছেন অটল, অনড়। সুদীর্ঘ জীবন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। গত তিন দশকে এ ধরনের এমন কোনো আন্দোলন ছিল না, যার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। স্বৈরাচারী সরকারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। এর পাশাপাশি সাহিত্যচর্চায় তিনি ছিলেন নিরলস। ১৯১১ সালে জন্ম নেওয়া কবি সুফিয়া কামালের ১২ বছর বয়সে বরিশালের তরুণ পত্রিকায় ‘সৈনিক বধূ’ গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয় তাঁর ২৪ বছর বয়সে। তাঁর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন, সমাজ পর্যবেক্ষণের কারণে এই গ্রন্থের গল্পগুলো হয়ে উঠেছিল সময়কালের নিরিখে উল্লেখযোগ্য।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে কাব্যচর্চায় উৎসাহিত করেছেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা পড়ে আশীর্বাণী পাঠিয়েছেন। তাঁর ১৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী লিখলেও তিনি মূলত কবি। তাঁর লেখা কবিতা ও অন্যান্য গ্রন্থ রাশিয়া ও আমেরিকায় রুশ ও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
তাঁর এই সুবিশাল কর্মজীবন আমাদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অসীম প্রেরণা ও যুগান্তকারী এক পাথেয়। তাঁর জীবনের পরিপূর্ণ শিক্ষাকে আমরা যেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি।