মাওয়া থেকে ঢাকামুখী গাড়ি পোস্তগোলা রেল ক্রসিংয়ে ২৫০ মিটার রাস্তা পার হতে সময় যেত দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এখন সেই দূরত্ব কমে ১০ সেকেন্ডে নেমেছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে এ সুফল মিলছে। আজ বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘এক্সপ্রেস কন্ট্রোল এক্সপ্রেসওয়ে’র উদ্বোধন করবেন।
রাজধানী যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এবং পদ্মা সেতুর ওপরে পানছার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে সার্ভিস সড়ক দুই লেন। এই দুই লেনের সার্ভিস সড়কে ধীরগতির স্থানীয় যানবাহন চলাচল করবে। আর মূল চার লেনে চলবে দ্রুতগতির যানবাহন। সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোমিটার গতিতে চালানো যাবে মোটরযান। সর্বাধুনিক ট্রাফিক সিস্টেমে তৈরি এই এক্সপ্রেসওয়েতে আলাদা আলাদা লেন ধরে একদিকেই সব গাড়ির চলাচল, ক্রসিং এড়াতে উঠেছে ফ্লাইওভার, রয়েছে আন্ডারপাস। নান্দনিক সৌন্দর্যের সবকিছুই রয়েছে এই এক্সপ্রেসওয়েতে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার সঙ্গে সর্বাধুনিক দ্রুত গতির হাইওয়ের সুবিধায় বদলে যাবে এসব এলাকার অর্থনীতির চালচিত্র।
ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার হচ্ছে এই পথ। চলাচলকারী সাধারণ মানুষ ও গাড়িচালকরা দারুণ স্বস্তি প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার আজকালের খবরকে বলেন, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক সড়কের চেয়ে উন্নত। খুবই সুন্দর একটি সড়ক। ইতোমধ্যেই মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। যারা এই সড়কে যাচ্ছেন তারাই অবাক হচ্ছেন। বাংলাদেশে এরকম সড়ক আগে কেউ কল্পনা করেননি। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সড়কের পুরো সুবিধা পাবেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৫৫ কিলোমিটার সড়কে ৫৪টি কালভার্ট, ১৯টি আন্ডারপাস, চারটি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু, পাঁচটি ফ্লাইওভার, দুটি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভারপাস রয়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাসিন্দাদের রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত সুগম হবে। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ছয় জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষ সরাসরি এই এক্সপ্রেসওয়েতে উপকৃত হবেন। এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটি ফ্লাইওভারের মধ্যে একটি দুই দশমিক তিন কিলোমিটার কদমতলী-বাবুবাজার লিংক রোড ফ্লাইওভার। অন্য চারটি ফ্লাইওভার করা হয়েছে আবদুল্লাহপুর, শ্রীনগর, পুলিয়াবাজার ও মালিগ্রামে। এক্সপ্রেসওয়ের জুরাইন, কুচিয়ামোড়া, শ্রীনগর ও আতাদিতে চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ এবং চারটি বড় সেতু রয়েছে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী আরিফ চৌধুরী গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে মাওয়া গিয়েছিলেন এই সড়ক দেখতে। তিনি আজকালের খবরকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে দেখে আমি অবাক। এটা বাংলাদেশের সড়ক! এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়িতে যাওয়ার সময় আমার মনে হয়েছে আমি যুক্তরাজ্যের কোনো মহাসড়কে চলছি। এই এক্সপ্রেসওয়ের সৌন্দর্য দেখে গর্বে বুকটা ভরে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতোই এখন আমাদের দেশের সড়ক। এটি সরকারের উন্নয়নের চিত্র। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। উনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। উনার হাত ধরেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।
এই পথে চলাচলকারী বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা যারা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, তাদের জন্য এর চেয়ে খুশির আর কোনো খবর হতে পারে না। এ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে যারা গেছেন শুধু তারাই উপভোগ করতে পেরেছেন এই আনন্দটা। এই সড়কে গাড়ি যাওয়ার সময় মনে হয় না আমি বাংলাদেশে আছি। মনে হয় দুবাইয়ের রাস্তায় চলছি। এ জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য পদ্মা সেতু। সেতুর কাজ শেষ হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, যেখানে আমার বাড়ি বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায় ঢাকা থেকে যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগত, সেখানে এখন চার ঘণ্টা সময় কম লাগছে। আর পদ্মা সেতু হয়ে গেলে আরও চার ঘণ্টা কমে ঢাকা থেকে বামনা চলে যাব মাত্র চার ঘণ্টায়। এটা যেন স্বপ্নের মতো।
এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা ইতোমধ্যে পাওয়া শুরু করেছেন জানিয়ে গুলিস্তান থেকে মাওয়া রুটের ইলিশ পরিবহনের চালক আবদুল্লাহ আজকালের খবরকে বলেন, মাওয়া থেকে ঢাকা আসতে সময় ভেদে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতো। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় যানজট ছিল পোস্তগোলা রেলক্রসিং। এক্সপ্রেসওয়েতে রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস করে দেওয়া হয়েছে। ২৫০ মিটার সড়ক পার হতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত। এখন লাগে মাত্র ১০ সেকেন্ড। নিরাপদ সড়ক বলতে যা বুঝায় তা হলো এই সড়ক। দুর্ঘটনার আশঙ্কা একেবারেই কম।
আবদুল্লাহ আরও বলেন, ঢাকা থেকে মাওয়া যেতে এখন মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগে। আর সড়কে কোনো ধাক্কা নেই। খুবই সুন্দর সড়ক। আগে দুবাইয়ের সড়কের গল্প শুনতাম, এখন চোখে দেখছি।