ডাকনাম তাঁর ‘ইকবাল’, আমাদের অমার্জনীয় বিস্মরণে ‘বীরউত্তম’ প্রাপ্ত এই শহীদ হারিয়ে গেছেন। আজ ২৭শে এপ্রিল, ঠিক ৪৯ বছর পূর্বের আজকের দিনটিতেই সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাতের মেহেদী মুছে দিয়েছিলেন স্বদেশের তরে প্রাণ উৎসর্গকারী এই মুক্তিযোদ্ধা।
আফসোস ভিনদেশী চলচ্চিত্রের কাল্পনিক নায়কদের নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে থাকি। অথচ, জন্মভূমির জন্মলগ্নের দুঃসাহসী দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সত্য ইতিহাস থেকে যায় অজানা। আজ সেনা কর্মকর্তা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ইকবালের ৪৯ তম শাহাদাত বার্ষিকী।
তাঁর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। তবে পৈত্রিক গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) রামগঞ্জ থানাধীন টিওড়া গ্রামে। পিতা স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন পুরাতন ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লাল মোহন পোদ্দার লেনে। সেখানেই অকুতোভয় এই সৈনিকের শৈশব কাটে। পিতা মরহুম আব্দুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা, রওশন আরা বেগম ছিলেন গৃহিনী।
পিতার সরকারি চাকুরির সূত্রে তাঁর কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ শহরের ‘মৃত্যুঞ্জয় স্কুল’ থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে ‘আনন্দ মোহন কলেজ’ থেকে এইচএসসি পাশ করে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ক্যাপ্টেন আফতাব ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১৯৭০ সালে হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান করেন।
ভালোবাসতেন খালাতো বোন জুঁইকে, তিনিও তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁরা বিয়ে করবেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর চাকরির কারণে সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না। কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদের ফিল্ড রেজিমেন্টে। অবশেষে তাঁর সেই সুযোগ হলো ১৯৭১ সালে। ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন। ২০ মার্চ চট্টগ্রামে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয় তাঁদের। কয়েক দিন পর আনুষ্ঠানিক জীবন শুরু করবেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর আগেই জন্মভুমিতে নেমে এলো মানব ইতিহাসের বেদনাদায়ক ২৫ মার্চের কালরাত। সেরাতে পুরনো ঢাকার ফরিদাবাদে ছিলেন তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়িতে।
একদিকে নববধূ অপরদিকে জন্মভুমি ও মানুষের ডাক। একদিকে জীবন অন্যদিকে মৃত্যু। যুগের এমনই সন্ধিক্ষণে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর বিপক্ষে অস্ত্র তুলে নেবার পথকেই। ২৮ মার্চ ১৯৭১, মাকে বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে যুদ্ধে অংশ নিতে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব, ফরিদাবাদের বাসা থেকে চট্টগ্রামের পথে বেরিয়ে পরেন।
ফেনী’তে গিয়ে তিনি শুভপুরের যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগ দেন। শুভপুর ব্রীজ এলাকায় তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রী সেনা নামাচ্ছিল। পাকিস্তানী ছত্রীসেনাদের একজনকে ক্যাপ্টেন আফতাব প্রামবাসীর সহায়তায় ধরে ফেললেন। বন্দী ছত্রীসেনাকে নিয়ে ২ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে পৌঁছান রামগড় শহরে।
৩ এপ্রিল ১৯৭১, স্বাধীনতার যুদ্ধে শুরু হয় ক্যাপ্টেন আফতাব এর ব্যস্ত জীবন। ইপিআর বাহিনীর হাবিলদার কালামের প্লাটুন নিয়ে স্থাপন করেন জোরালগঞ্জের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। নেতৃত্ব দেন ধূমঘাটের রেলওয়ে ব্রীজ উড়িয়ে দেবার অপারেশনে।
(এ ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ৫ এপ্রিল ১৯৭১)
রামগড়ে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন আফতাব দেখলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার কয়েকশ ছাত্র ও যুবক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ৫০০ তরুণের একটি দলকে সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন আফতাব রামগড় হাইস্কুল মাঠে স্থাপন করলেন একটি ট্রেনিং সেন্টার।
স্থানীয় জনগণ তাঁদের থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করলেন। ওদিকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার কাজে নিয়োজিত থাকলো। সম্ভবত, ২০ এপ্রিল মেজর মীর শওকত খাগড়াছড়ি শহরে অবস্থান করছিলেন। মেজর শওকতকে খাগড়াছড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে মেজর জিয়া’র বাহিনী মহালছড়িতে পৌঁছান। সেখানের ‘মহালছড়ি’ ছিল মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান।
ক্যাপ্টেন আফতাব এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এই সেনাদলের সাথে মহালছড়িতে পৌঁছান। মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বাধীন বাহিনী কালুরঘাট ব্রীজ এলাকা থেকে পিছু হটে কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি হয়ে এরই মধ্যে মহালছড়ি এলাকায় এসে অবস্থান নিয়েছিল। মেজর মীর শওকতের বাহিনী তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রবল চাপের মুখে।এদেরকে নিরাপদে রামগড়ে রিট্রিট করাবার জন্যই তাঁরা অতিরিক্ত সেনাদল নিয়ে মহালছড়িতে পৌঁছান। মেজর শওকতকে রামগড়ের উদ্দেশ্যে পিছু হটার নির্দেশ দিয়ে মেজর জিয়া ফিরে গেলেন রামগড়ে। ক্যাপ্টেন আফতাব থেকে গেলেন মহালছড়িতে।
২৭ এপ্রিল ১৯৭১, সকাল থেকে মহালছড়ির চারদিকে থমথমে অবস্থা। প্রতিরোধযোদ্ধারা খবর পেয়েছেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি তাঁদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল সেনার নেতৃত্বে আছেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের।
স্মর্তব্য, ১৯৭১ সালে মিজোরা পাকিস্তানী অমানুষ’দের পক্ষাবলম্বন করেছিল। সেদিন (২৭ এপ্রিল ১৯৭১) আনুমানিক সকাল ৯ টার দিকে ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানী কমান্ডো দল তাঁদের অবস্থানে আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের সময় দেখা গেল, পাকিস্তানীদের সঙ্গে বিদ্রোহী মিজোরাও আছে। সব কিছুই মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণার বাইরে ছিল।
দুই কোম্পানি পাকিস্তানি কমান্ডো ও প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী মিজোরা, মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। অসীম সাহসের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানী সেনা কমান্ডো ও মিজোদের মোকাবিলা করতে থাকেন। ঘণ্টা তিন তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চলার পর তাঁদের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা বেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। সম্মুখ যুদ্ধের সে মুহূর্তে কৌশলগত কারণেই পাকিস্তানী ও মিজোদের ঘেরাও বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবনকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার নির্ভরতা।