বিভাগ জাতীয়

৬-দফার সিঁড়ি বেয়েই ‘৬৯-‘৭০ পেরিয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধঃ মোহাম্মদ হাসান

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

আজ ঐতিহাসিক ৭ জুন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৬৬ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফায় কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়। ৬-দফায় বাঙালি খুঁজে পায় তাদের মুক্তির ঠিকানা। ছয় দফা হয়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলনের ম্যাগনাকার্টা। পূর্ণ স্বাধীনতা যার যৌক্তিক পরিণতি। ৬-দফার সিঁড়ি বেয়েই ৬৯-এর ছাত্র গণ আন্দোলন,’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে এক সম্মেলনে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে  ছয় দফা পেশ করেন। এর কিছুদিন পর ১৯৬৬ সালে  আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ৬-দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে আবারও শেখ মুজিবুর রহমান পেশ করেন এবং দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ৬-দফার ব্যাপক প্রচার শুরু করে আওয়ামী লীগ। অল্পদিনের মধ্যে ছয় দফা বাংলার মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ছয় দফা বাঙালির বাঁচার দাবি মুক্তিসনদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
পরবর্তীতে শেখ মুজিব বলেন,‘ওটা ছয় দফা নয়,এক দফাই ঘুরিয়ে বললাম শুধু। শেখ মুজিব ছয় দফা পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শাসকমহলে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এ সময় প্রকট রূপ ধারণ করে। ছয় দফা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের দুই অংশের  আঞ্চলিক বৈষম্যের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃক ‘সোনার বাংলা শশ্মান কেন’ শিরোনামে একটি প্রচারপত্র বিতরণের ফলে পাকিস্তানি শাসকচক্র বেসামাল হয়ে পড়ে। আইয়ুব, মোনায়েম ও ভুট্টোসহ অনেকে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে।
শেখ মুজিব দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে এ-কথা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানিরা ছয় দফা মানবে না,মানতে পারে না। কারণ ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে এক পাকিস্তান থাকবে না। পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশ ৫টি স্বায়ত্তশাসিত দেশে পরিণত হবে। সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে ছয় দফা দাবি আদায়ের জন্য শেখ মুজিব ছয় দফা পেশ করেননি। শেখ মুজিবের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, ছয় দফা ছিল রাজনৈতিক কৌশলমাত্র।
এক পাকিস্তানের রাজনীতির পরিধিতে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবি তোলা ছিল অসম্ভব। যে কোনো রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম হবেন যে পাকিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে স্বাধীনতার প্রকাশ্য দাবি করলে শেখ মুজিবের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার হতো এবং ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো। এমতাবস্থায় শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করেন স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে।
পাকিস্তানিরা যেমনি ৬-দফাকে মানতে পারেনি, তেমনি শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতেও পারেনি । শেখ মুজিব এমন এক অভূতপূর্ব নবতর রাজনেতিক কৌশলে অবতীর্ণ হন, যার ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পরির্পূণতা লাভ করে এবং সমগ্র জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধাবিত হয়। সুতরাং এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ছয় দফা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এমন এক দাবিনামা যেখান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন গতি লাভ করে।
শেখ মুজিব ৬-দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় জনসংযোগ শুরু করেন। এ সময় তাঁকে খুলনা,যশোর,সিলেট, ময়মনসিংহ  ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। বছরের প্রথমে তিন মাসে  তিনি আট বার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
৭ জুন শেখ মুজিব ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে র্ধমঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গিতে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং বহু নেতাকর্মী আহত হয়। পুলিশ দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। দুপুরে আদমজী  সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকরা ১৪৪ ধারা লংঘন করে শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। ইপিআর বাহিনী একটি শোভাযাত্রায় গুলিবর্ষণ করে। বেলা ১১ টায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। হরতালের পরের দিন গুলিতে আহত একজনের মৃত্যু হয়। সরকারি ভাষ্য অনুসারে ১১ জনের মৃত্যু স্বীকার করে; কিন্তু নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল। ঐদিন সন্ধ্যার পর সরকার কারফিউ জারি করে।” সংবাদ জগতের নির্ভীক সৈনিক পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠ ইত্তেফাকের সবচেয়ে জনপ্রিয় অঙ্গ  ‘রাজনৈতিক মঞ্চের ’ লেখক মোসাফির তথা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কে আইয়ুব-মোনেম চক্রের নির্দেশে পুলিশ ১৬ জুন ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। একই দিনে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রেস ১নং রামকৃষ্ণ মিশন রোড়স্থ ‘ নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ২০ মাস জেলে আটক রাখার পর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে সামরিক হেফাজতে নেওয়া  হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বিচার শুরু করে। কিন্তু  গণ-আন্দোলনের চাপে পাক সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬-দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ২৮ অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভি ভাষণে ছয় দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ১৯৭১ সালের ২ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ পরিচালনা করেন। দলীয় সদস্যরা ৬-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি নেতাদের সাথে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন ছয় দফা প্রশ্নে চুল পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না। পাকিস্তানি নেতারা বারবার বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছেন ছয় দফা থেকে সরে আসার জন্য। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। কারণ এই ৬-দফাই ছিল বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored