ইদলিব প্রশ্নে সম্পূর্ণ বিশ্লেষনের পূর্বে ইদলিবের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা যাক । সিরিয়ার ইদলিব শহরটি সিরিয়ার মূল অংশ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ৷ বিচ্ছিন্ন বলার কারণ আলেপ্পোর পরে ইদলিবই হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে আসাদ-বিরোধীদের প্রাণকেন্দ্র ।
আইএস-বিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৯ এর প্রথমদিক পর্যন্ত তুরস্ক , তুরস্ক সমর্থিত মিলিশিয়া ( ফ্রি সিরিয়ান আর্মি , হায়াত আশ শাম আল তাহরীর ) , কুর্দি গেরিলা সংগঠন ( এসডিএফ , পিকেকে , ওয়াইপিজি ) এবং ইরান ( কুদস ফোর্স ) ও ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া ( হিজবুল্লাহ , পিএমএফ ) , রাশিয়া এবং সিরিয়ার সেনাবাহিনী ( টাইগার ফোর্স ) একযোগে সাড়াশি অভিযান শুরু করে যার মাধ্যমে কার্যত আইএসের দখলদারিত্বের পতন ঘটে । তবে এই আইএস বিরোধী যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হয় তুরস্ক কারন সিরিয়ার ইদলিব সহ সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তবর্তী বিশাল অংশ তুর্কি সমর্থিত বাহিনীর কন্ট্রোলে আসে ।
আইএস বিরোধী যুদ্ধের পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে । তুরস্কে ব্যার্থ সেনাবিপ্লবে অভিযুক্ত হয়ে পদ হারায় হারায় হাজারো অফিসার । সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে তুরস্কের বিমানবাহিনী । প্রায় ৮০ শতাংশ পাইলটকে অব্যহতি দেওয়া হয় । এই বিপ্লবের জেরে তুরস্কের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে ঠেকে । এই বিপ্লবের পর ঐতিহাসিক শত্রু রাশিয়ার সাথে আপাত বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় এবং রাশিয়া থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে সম্মত হয় । এর জেরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে তুরস্ককে বের করে দেয় এবং তাদের উপর সর্বপ্রথম CAATSA আরোপ করা হয় ।
এরই মধ্যে ভু-রাজনৈতিক হাওয়া অন্যদিকে প্রবাহিত হয় । তুরস্ক তাদের দেশের সিরিয় শরনার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ার লক্ষে ইদলিবের আশেপাশে একটি নির্দিষ্ট এলাকা দাবী করে এবং স্বভাবতই কুর্দি সশস্ত্র গেরিলারা এই এলাকার দাবী প্রত্যাখ্যান করে । ফলে তুরস্ক তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যায় এবং তাদের হটিয়ে ওই সীমানা পর্যন্ত এলাকা দখল করে । এই অভিযানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ বিষয় লক্ষনীয় । এই অভিযান চলাকালে কার্যত রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া নীরব ছিল এবং এটা বলা হয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বেইজগুলো থেকে তুরস্ককে কুর্দি অবস্থানের বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করছিল । তবে এই অভিযান সবচেয়ে সুফল বয়ে আনে এরদোগানের জন্য । খোদ তুরস্কে এরদোগান-বিরোধী শিবিরও এই অভিযান সমর্থন করেছিল ।
এই অভিযানের পরপর এই অঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক হাওয়া আবার অন্যদিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে । এই বছরের শুরুর দিকে সিরিয়ার দখলকৃত ভূমি তুরস্ক থেকে ফেরত চায় সিরিয়া এবং ইরান-রাশিয়া তাতে সমর্থন যোগায় । তুরস্ক সিরিয়ার দাবীতে রাজি না হয়ে দখলকৃত অঞ্চলে ভারী অস্ত্র মোতায়েন শুরু করে এবং প্রাথমিকভাবে সিরিয়ার সেনাবাহিনী এই অঞ্চল থেকে চলে যাওয়া শুরু করে । কিন্ত ইরান-রাশিয়ার সমর্থনে ঐ অঞ্চলে তারা আবারো শক্তিসঞ্চয় করে এবং তুরস্ক সমর্থিত গেরিলাদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান শুরু করে । এই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের হামলায় ৭০ এরও বেশি সিরিয় সৈন্য নিহত হওয়ায় রাশিয়া এই অভিযানে এগিয়ে আসে এবং রাশিয়ার হামলায় তুরস্কের ৬টি সামরিকযান সহ ১১ জন তুর্কি সেনা নিহত হয় ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে চলমান এই অভিযানে তুরস্কের উদ্দেশ্য সফল হবার সম্ভাবনা কত এবং ভবিষ্যতে এই অভিযান কিরকম ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে । তুরস্কের সেনাবাহিনী আর তুরস্ক সমর্থিত মিলিশিয়ার বিপক্ষে এই যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করছে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিপুল পরিমান সেনা এবং মিলিশিয়ারা । বিপুল পরিমান এই সেনার বিপক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করা তুরস্কে পক্ষে আত্নহত্যার সামিল । এদিকে তুরস্কের সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীতে বিপুল পরিমান দক্ষ অফিসার এবং পাইলটের অভাব রয়েছে । তাই এ মুহুর্তে তুরস্কের পক্ষে এই অভিযান পরিচালনা করা আগুন নিয়ে খেলা করার মতো । এই অভিযানে সিরিয়ার ভিতর থাকা ২৫ টি সামরিক পোস্টের মধ্যে ৭টি দখল করে নিয়েছে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোট । তাই একরকম আগুন থেকে রক্ষার জন্য তুরস্ক নিজে থেকেই প্যারিসে ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত । অন্যদিকে হামলার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে তুরস্ক তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া মিত্র আমেরিকা থেকে ইদলিবে প্যাট্রিওট ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের আহবান জানিয়েছে ।
পরিশেষের প্রশ্ন , এই অভিযান পরিচালনা এরদোগানের জন্য কতোটা আশঙ্কাপূর্ণ? মোটা দাগের নিচে দেখলে এই মূহুর্তে তুরস্কের সাথে কেউই নেই । এরদোগান দুই নৌকায় চলতে গিয়ে আরব লীগ , ন্যাটো , রাশিয়া সবারই আস্থা হারিয়েছে । অন্যদিকে খোদ তুরস্কে এরদোগান বিরোধী একটি তীব্র হাওয়া বইছে । তুরস্কের স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনে বিরোধীদের জয়জয়কার সেটিই বলে দিচ্ছে । এই অভিযানে সফলতা লাভ করলে শুধু এরদোগানেরই উত্থান হবে , আর ব্যর্থ হলে এরদোগান সমগ্র তুরস্ককে সাথে নিয়েই ডুববে।
তবে ইদলিব ইস্যুতেই কি এরদোগানের হঠকারিতার পতন ধ্বনি শোনা যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দিবে ।
লেখকঃ সাকির ইমরোজ