বিভাগ মত-দ্বিমত

বন্ধ হোক শাসনের নামে বিদ্যালয়ে শিশু নির্যাতন

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীন পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের বিদ্যালয়গুলোতে এখনো পর্যন্ত শিশুকে শাসন করার নামে নির্বিচারে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি এবং নির্যাতনের প্রচলন বিদ্যামান রয়েছে। সারা দেশে করা শিশু জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুর শারীরিক শাস্তি ও নির্যাতনের ঘটনা খুবিই বেশি। যা কিনা পূর্বে সর্বোচ্চ ৯০% পর্যন্ত ছিলো। ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের স্বাক্ষরিত একটি জরুরি পরিপত্র জারিরমাধম্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। পরিপত্রের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘দেশের প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’পরবর্তী সময়ে ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে শিশুর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধের আদেশ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একাধিকবার পরিপত্র জারি করা হলেও তা আজ অবধি শতভাগ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে অবশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে ২০২০ সালে এসে এ শাস্তি প্রদানের হার ও প্রবনতা ৩৬% এর নিচে নেমে এসেছে বলে প্রতিয়মান হয়।

বিদ্যালয়ে শিশুকে কারণে বা অকারণে শারীরিক এবং মানসিক শাস্তি প্রদান একটি মারাত্বক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমান সময়ে আধুনিক বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শাস্তি প্রদানের হার প্রায় ০% এ পৌছে গেছে। সেখানে আমাদের দেশে এ চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ এবং হতাশাজনক। কার্যত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুকে শারিরীক বা মানসিক শাস্তি দিলে তা শিশুর জীবনে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বিদ্যালয়ে শিশু শাস্তি শিশুর ভারসাম্যপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্বকভাবে বাধাগ্রস্থ হতে পারে। তাছাড়া শিশুর মনে শিক্ষাভীতি মারাত্বক আকার ধারণ করে এবং বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিশু ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিদ্যালয়ে শিশুকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান। এ মুহুর্তে শিশু জরিপ যাই বলুক না কেন, এখনো পর্যন্ত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশু ঝরে পড়ার হার ১৮% বা তার কাছাকাছি রয়েছে।

বিদ্যালয়ে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি কিম্বা বেত্রাঘাত শিশুদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বাহিরেও শিশুকে ভয়ানকভাবে হীনমন্য করে তোলে এবং এর ফলে শিশুরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। শ্রেণকক্ষে সহপাঠীদের সামনে শারীরিক শাস্তি প্রদানকে শিশুরা শারীরিক ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি মানসিক লজ্জার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। বিশেষ করে যে শ্রেণিকক্ষে ছেলে-মেয়ে একত্রে সহশিক্ষা বিদ্যামান থাকে, এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বালক বালিকা উভয়ের জন্যই এই শাস্তি প্রদানের ঘটনা অত্যন্ত বিব্রতকর এবং লজ্জাজনক হয়ে থাকে। অনেক সময় শাস্তি পাওয়ার কারণে কোমলমতি শিশুরা ভয়ে বা লজ্জায় স্কুলে আসতে চায় না। যা শিশুর স্বাভাবিক এবং নিরাপদবোধ পরিবেশে শিক্ষা অর্জনের পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে থেকে যাচ্ছে।

আবার শহর পর্যায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে শারীরিক শাস্তি প্রাদানের হার ও প্রবনতা যথেষ্ঠ কম বলে মনে হলেও এখানে কিন্তু শিশুকে পরোক্ষভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। বিশেষ করে বিদ্যালয়ে শিশুর উপর অতিরিক্ত বই এবং পড়ার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শিশুকে সার্বক্ষণিক মানসিক দুশ্চিন্তা এবং ভয়ে রাখা হয়। কার্যত বিদ্যালয়গুলোতে সরকারি নিয়মের বাহিরে শিশুকে অতিরিক্ত বই পড়তে বাধ্য করার মাধম্যে শিশুর সুন্দর এবং নিরাপদবোধ শিক্ষা অর্জনের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। আসলে শিক্ষার নামে অতিরিক্ত হোমওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট এবং পড়ার চাপ শিশুর মনে দীর্ঘস্থায়ী বিরুপ প্রভাব বিস্তার করে এবং পাশাপাশি শিশুর স্বাভাবিক জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি কিম্বা ইতিবাচক সৃজনশীলতা অর্জনে বড় ধরণের বাধা হিসেবে দেখা দেয়। অতিরিক্ত বই ও পড়ার চাপ শিশুর কাছে একটি বড় বোঝা এবং অনেকটা এক ঘেয়ামীহয়ে যায়। তাছাড়া হতাশার কারণে পরবর্তী জীবনে এসব শিশুর মাঝে মাদকাসক্ত কিম্বা অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবার প্রবল সম্ভবনা প্রায় ৩৫% বা তার বেশি হতে পারে।

১৯৮৯ সালে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ধারা ১৮-১৯ এর আইন অনুযায়ী প্রশাসনিক, সামাজিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুরা যাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ইঞ্জুরি এবং কোন প্রকার অন্যায়ের সুবিধাভোগীর শিকার না হয় সেজন্য উপযুক্ত সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে। এই সনদে শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করাসহ সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে শিশুকে সুরক্ষা দিতে বলা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুই নির্যাতন বা নৃশংস অমানবিক মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হবে না।

এখানে প্রকাশ থাকে যে,আমাদের দেশে শিশুর ওপর শারীরিক এবং মানসিক শাস্তি বা নির্যাতনের কারণগুলো কিন্তু বেশ আজব ধরণের। যেমন শ্রেণীকক্ষে বসে কথা বলা, শিক্ষকের পড়া অনুসরণ না করা, বাড়ির কাজ করে না আনা, শ্রেণিতে পড়া না পাড়া বা দুষ্টুমি করা ইত্যাদি। আর এসব কারণে শিশুকে অহেতুক শারীরিক শাস্তি প্রদান খুবই দূঃখজন এবং অগ্রহণযোগ্য। তাই প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুর স্বাভাবিক শিক্ষা এবং অর্জিত যোগ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষে আমাদের দেশের সরকার এবং সর্বপরি শিক্ষকদের আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। যতটা সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নিয়োগকৃত শিক্ষক কতটা শিশুবান্ধব হবেন তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর মানবিক গুণাবলি কখনো এক হয় না। শিক্ষক নিয়োগদানের আগে আমাদের সরকার এসব বিষয়ে আরো সচেতন হতে পারেন। তাছাড়া শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিশুর প্রতি দায়বদ্ধতা কিন্তু অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু খুব সহজেই শিশুদের শিক্ষাজীবনের এই প্রথম ধাপগুলোকে আরোও একটু মসৃণ করতে সহায়তা করতে পারি। তাই আমরা অহেতুক শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক শাস্তি না দিয়ে, বরং তাদের ভুলগুলোকে ভালোবাসা এবং স্নেহের মাধম্যে শুধরে দিতে পারি। তাই এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা পরিহার করে এবং পাঠদান যাতে এক ঘেয়ামী না হয় সেদিক লক্ষ্য রেখে শিশুবান্ধব এবং শতভাগ যোগ্যতা ভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored