দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুই চীর বৈরি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীরে সংঘর্ষ প্রবণ সীমান্ত লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) দিয়ে নিয়মিত বিচ্ছিন্নতাবাদীর অনুপ্রবেশ এবং একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে ব্যাপক মতানৈক্য ও সারা বছর ব্যাপী ভয়ঙ্কর মাত্রায় সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীরে পুলওয়ামারে স্বাধিনতাকামী ও ভারতীয় সেনার ব্যাপক সংঘর্ষে দফায় দফায় প্রায় ৬০ জন সেনা বা জাওয়ানের করুন মৃত্যুতে দেশ দুটির মধ্যকার স্পর্শকাতর দূর্বল সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ মুহুর্তে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী একে অপরের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে সীমান্তে হামলা ও পালটা হামলা অব্যহত রেখেছে এবং দেশ দুটি নজিরবিহীনভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বিমান হামলা ও পালটা বিমান হামলা চালিয়েছে। তাছাড়া দেশ দুটির সামরিক বাহিনীর একটি বৃহৎ অংশ সার্বক্ষণিকভাবেই সুদীর্ঘ লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর মোতায়েন রাখে এবং তারা উভয়েই এক রকম নীরবেই নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী ভয়াবহ রকমের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ প্রস্তুতি বা সমর সজ্জায় নিজেকে ঢেলে সাজাচ্ছে বলে আশাঙ্খা করা হয়।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, ভারত প্রায় চার দশক আগেই ১৯৭৪ সালের শুরুতেই পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার মাধম্যে তাদের নিজস্ব নিউক্লিয়ার ওয়ার ক্যাপাবিলিটির বিষয়টি বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। তাছাড়া, প্রায় দুই দশক আগে ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্থান পাল্টাপাল্টি একাধিক নিউক্লিয়ার ফিউসন পরীক্ষা ও প্রযুক্তি অর্জনের মাধ্যমে এক ভয়ানক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এদিকে এ দুটি দেশ পারমানবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ এবং পাশাপাশি উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর কৌশলগত দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প পাল্লার ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র উন্নয়ন ও গবেষণায় ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এহেন নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিশ্চিতভাবেই অদূর ভবিষ্যতে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে ভয়াবহ রকমের নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের সামরিক গবেষনামুলক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, স্টকহোম ভিত্তিক ইন্টারন্যশনাল পীস রিসার্চ ইনিস্টিটিউ, গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার, বিসনেস ইন্সাইডারসহ আন্তজার্তিক পর্যায়ের একাধিক সামরিক গবেষণা সংস্থা ও থিংক ট্যাংকের বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ মুহুর্তে পাকিস্তানের অস্ত্র ভান্ডারে ১৪০টি এবং ভারতের কাছে আনুমানিক ১২০টি নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ারর ডিভাইস এন্ড ওয়ারহেড মজুত থাকতে পারে। যদিও এ পরিসংখ্যানটি নিরপেক্ষ কোন মাধ্যমে প্রমান করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া দেশ দুটি কিন্তু কোন দিনই তাদের নিউক ক্যাপাবিলিটি নিয়ে প্রচার মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের স্ট্রাটিজিক মিসাইল ফোর্সের অস্ত্র ভাণ্ডারে আরো বেশি সংখ্যক কমপক্ষে দ্বিগুণেরও বেশি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এণ্ড ডিভাইস থাকার সমুহ সম্ভবনা থেকেই যাচ্ছে। এদিকে ভারতের আরেক চীরবৈরী দেশ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক পরাশক্তি চীন নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত গোপনেই নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ার অস্ত্রের সুবিশাল মজুত গড়ে তুলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের অস্ত্র ভান্ডারে এ মুহুর্তে ২৮০টি এর কাছাকাছি পারমানবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি বিশ্বের সামনে উঠে আসলেও ২০১৪ সালের দিকে মার্কিন-তাইওয়ান ভিত্তিক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়, চীন অত্যন্ত গোপনে তাদের সারা দেশব্যাপী ভুগর্ভে একাধিক গোপন ঘাঁটি ও গবেষণাগারে নতুন প্রজন্মের ব্যালেস্টিক এণ্ড ক্রুজ মিসাইল বেসড হাজারের অধিক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড উন্নয়নে এবং সর্বপরি দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প পাল্লার স্ট্র্যাটিজিক্যাল ক্ষেপনাস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। আরেক হিসেব মতে চীনের স্ট্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে এ মুহুর্তে আনুমানিক ১৬৮০টি এর কাছাকাছি বিভিন্ন পাল্লার কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্র মজুত রয়েছে। যেখানে খুব সম্ভবত ভারতের কাছে আনুমানিক ২০০টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৬০টি দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প পাল্লার স্ট্রাটিজিক এন্ড ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণস্ত্রের বিশাল মজুত থাকতে পারে এবং এ সংখ্যাটি কিন্তু প্রতি বছরই আশাঙ্খাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
পাকিস্তানের পারমানবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ একাধিক ক্ষেপনাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে মধ্যম পাল্লার শাহীন-৩, শাহীন-২ ও স্বল্প পাল্লার শাহীন-১ ক্ষেপনাস্ত্র। পাকিস্তানের অস্ত্র ভাণ্ডারে এ মুহুর্তে ভারত কিম্বা চীনের মতো বিশাল আকারের ৫,০০০-১২,০০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পাল্লার কৌশলগত ইন্টার কন্টিন্যান্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) না থাকলেও পাকিস্তান অবশ্য ইতোমধ্যেই তাদের মোবাইল লাউঞ্চ বেসড মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ যোগ্য শাহিন-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের একাধিক সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে এবং পাকিস্তানের তৈরি শাহিন-৩ ক্ষেপনাস্ত্রের সর্বোচ্চ ২,৭৫০ কিলোমিটার দূরুত্বের যে কোন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে পারমাণবিক ও প্রচলিত ওভারহেড আঘাত হানতে সক্ষম বলে প্রচার করা হয়। যদিও মনে করা হয়, পাকিস্তানের শাহিন-৩ ক্ষেপনাস্ত্র সর্বোচ্চ ৪৮ কিলোটন ধ্বংস ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রটি টার্গেটের ৩৫০ মিটারের মধ্যে নিউক হীট করতে পারে। এছাড়া ১৫০০ কিলোমিটার পাল্লার শাহীন-২ এবং ৯০০ কিলোমিটার পাল্লার শাহীন-১ ক্ষেপনাস্ত্রের বিশাল মজুত আগে থেকেই আছে। আবার পাকিস্তানের ভারত সীমান্ত বরাবর আজানা সংখ্যক ৬০ কিলোমিটার পাল্লার ট্যাকটিক্যাল সর্ট রেঞ্জ নসর ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এটি একটি গেম চেঞ্জার মিসাইল হিসেবে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া পাকিস্তানের সাবমেরিন ভিত্তিক ৭৫০ কিলোমিটার পাল্লার বাবর-২ এবং ৪৫০ কিলোমিটার পাল্লার বাবর-৩ নিউক্লিয়ার এণ্ড কনভারশনাল ওয়ারহেড ক্যাপাবল ক্রুজ মিসাইলের একাধিক সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া পাকিস্তান খুব সম্ভবত আরব সাগরে তাদের স্ট্যাটিজিক মিসাইল শাহিন-৩ এর আপগ্রেড ভার্সন শাহিন-৪ এর মিসাইল ফায়ারিং টেস্ট শুরু করে থাকতে পারে। খুব সম্ভবত শাহিন-৪ এর পাল্লা হতে পারে ৩৫০০-৩৮০০ কিলোমিটার বা তার কাছাকাছি। যদিও বিষয়টি এখনো পর্যন্ত কোন নিরেপক্ষ তথ্যসূত্রের মাধম্যে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে, ভারতের নিজস্ব কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ৩৫০০ কিলোমিটার পাল্লার অগ্নি-৪ অনেক আগে থেকেই মজুত আছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তার কৌশলগত উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং (এমআইআরভি) ওয়ারহেড ক্যাপবল নতুন প্রজন্মের ৫৫০০-৮০০০ কিলোমিটার পাল্লার অগ্নি-৫ ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রের বেশ কয়েকটি সফল উৎক্ষেপন পরীক্ষা সম্পন্ন করে ২০১৮ সালের শুরুতেই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর স্ট্যাটিজিক মিসাইল ইউনিটের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। আবার ভারতের পরমানু অস্ত্রবাহী স্ট্র্যাটিজিক্যাল অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রে একসাথে তিনটি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম এবং তা সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোটনে সক্ষমতার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এতে করে অগ্নি-৫ এর রেঞ্জের মধ্য চলে এসেছে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ এলাকাসহ চীনের একটি বিরাট অংশ। তবে ভারতের মধ্যম ২০০০ কিলোমিটার পাল্লার অগ্নী-২ সিরিজের ব্যালেস্টিক মিসাইল ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এবং ভারত কিন্তু এক রকম নিয়মিতভাবেই তাদের ভণ্ডারে থাকা অগ্নী-২ মিসাইলের ক্যাপাবিলিটি পরীক্ষা করে থাকে। ভারত অবশ্য পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর অজানা সংখ্যক সুপারসনিক গতির ২৯০-৪৫০ কিলোমিটার পাল্লার ব্রাম্ভস শর্ট রেঞ্জ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করে রেখেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিকতম সময়ে ভারত পরিবর্ধিত ৮০০ কিলোমিটার পাল্লার সুপারসনিক ব্রাম্ভস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করছে।
এছাড়া ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অর্গানাজেশন (ডিঅরডিও) নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন পাল্লার আকাশ, ত্রিশুল ও সাবসনিক নির্ভয় ক্রুজ মিসাইলের একাধিক ভার্সন সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে ম্যাসিভ প্রডাকশন শুরু করেছে বলে প্রতিয়মান হয়। এদিকে আবার ভারত অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক তাদের নিজস্ব নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ভিত্তিক “সেকেন্ড ইন নিউক্লিয়ার এট্যাক ক্যাপাবিলিটি” ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিলিয়ন ডলার খরচ করে যাচ্ছে। ভারত ইতোমধ্যেই তাদের সাবমেরিন ভিত্তিক ৩৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাল্লার কে-৪ ব্যালেস্টিক মিসাইলের একাধিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে সাবমেরিনে অজানা সংখ্যক কে-৪ এসএলবিএম সংযোজন সম্পন্ন করেছে। তাছড়া সাবমেরিন লাউঞ্চ বেসড ৭৫০ কিলোমিটার পাল্লার কে-১৫ এবং কে-৫ ব্যালেস্টিক মিসাইল কিন্তু পাকিস্তান ও চীনের জন্য একচি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকেই যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও ভারত একে অপরের বিরুদ্ধে এমন কি সুপার পাওয়ার চীনের পক্ষেও যে কোন অবস্থায় পারমানবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র হামলা বা যুদ্ধে সামিল হওয়াটা নিজের জন্য একটি ভয়ংকর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর যাই হোক না কেন, ভয়াবহ যুদ্ধ যে কোন সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান হতে পারে না তা অবশ্যই সকল পক্ষকে বুঝতে হবে এবং অন্যের উস্কানীতে বা ফাঁদে পা না দিয়ে আলোচনার টেবিলে সকল সমস্যার সমাধান করা উচিত বলে আমি মনে করি। আর যুদ্ধকে কিম্বা সেনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল কিম্বা ক্ষমতায় যাওয়ার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক পুরোনো কালচার হলেও দেশ ও মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ভয়ঙ্কর রীতি এবং কূটকৌশল আমাদের সকলকে আবশ্যিকভাবে পরিহার করা বা এড়িয়ে চলা উচিত।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংরা নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Leave a Comment