বিভাগ মত-দ্বিমত

মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সংরক্ষণ করা জরুরি

সাম্প্রতিক সংবাদ
তানভীর হাসান
Sponsored

মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালীর জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে কালজয়ী ও সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত/সম্ভ্রম আত্মত্যাগ এর বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা। অসীম সাহসীকতা, বীরত্বগাথা আত্মত্যাগ আর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট উৎরে যাওয়ার এক বড় ক্যানভাস। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই রচিত হয়েছে কিন্তু এর সূর্যসৈনিক যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই মুক্তিযোদ্ধারা আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যে আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। দিনদিন কমে যাচ্ছে এসব বীরের সংখ্যা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সংরক্ষণ করা অতীব জরুরি।

৪৯ বছর আগে জাতির যে সূর্যসন্তানেরা জীবনবাজি রেখে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতায় লড়্ইা করে আমাদের একটি স্বাধীন পতাকা উপহার দিয়েছেন সেই বীরসেনানীরা আজ জীবন সায়াহ্নে এসে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লড়ছেন নানা রোগ-ব্যাধির সঙ্গে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চিকিৎসা প্রাপ্তিতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মুক্তিযোদ্ধারা আজ হারিয়ে যাচ্ছেন, সকলেই জীবনের শেষ ধাপে। আশঙ্কা এক দশক পরে হয়ত দেশে আর কোন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে খুজেঁ পাওয়া যাবে না। যারা আমাদের একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ, একটি জাতীয় পতাকা দিলেন তাদের যুদ্ধকালীন এবং চতুর্মুখী বীরত্বগাথাঁ ইতিহাস ও সমাধি সংরক্ষণ করাই এখন বর্তমান প্রজন্মের প্রধান কর্তব্য। আগামী প্রজন্মের কাছে এই সব মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসীকতা,বীরত্বগাথা আত্মত্যাগের ইতিহাস পৌঁছে দেয়া আমাদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সংরক্ষণের উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি।

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও তালিকা হয়নি একাত্তরের শহীদদের। তাঁদের আলাদাভাবে সম্মানিত করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে কবরসহ অনেকের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে গেছে সময় পরিক্রমায়। এমনই প্রেক্ষাপটে সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ‘সমাধি’ সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণ, রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২২ মে পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রাথমিক অনুমোদন লাভ করে। সে অনুসারে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে গেজেটভুক্ত দুই হাজার ৯৩৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই ও কবর চিহ্নিত করার জন্য সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের গেজেটের কপিসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে জেলা প্রশাসকরা যে তালিকা পাঠিয়েছেন তাতে এক হাজার ৪০০-এর মতো মুক্তিযোদ্ধা কবর চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান জানান, প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সবার কবর এখন আর চিহ্নিত করা নেই তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সব মুক্তিযোদ্ধার ‘সমাধি’ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে ৩৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

সরকারের নতুন উদ্যোগে একই নকশায় সব মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকাকরণ করে সংরক্ষণ করা হবে। নকশা দেখেই যে কেউ চিনতে পারবে সেটি বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। প্রতিটি কবরের এপিটাফে মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া থাকবে। একেকটি কবর সংরক্ষণে ব্যয় হবে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সরকার ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সরক্ষণের উদ্যোগ ও প্রকল্পের অনুমোদন দিলেও আজ ২০১৯ সা্লে এসেও সেটা বাস্তবায়নের কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত ১৫ জুলাই ২০১৯, জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, ‘সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একই ডিজাইনের কবর তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থাকলেও কবরস্থান নির্মাণের কোনো কার্যক্রম বর্তমানে চলমান নেই। তবে প্রস্তাবটি বিবেচনা করা হবে।’

যারা আমাদের একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ, একটি জাতীয় পতাকা দিলেন তাদের যুদ্ধ কালীন এবং চতুর্মুখী বীরত্বগাথাঁ ইতিহাস সংরক্ষণ করাই প্রথম ও প্রধান কাজ আমাদের প্রজন্মের, তা না হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কিভাবে উদ্ভুদ্ধ হবে? দেশ প্রেমের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পাবে?

সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সমাধি’ সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখা সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে হলে সেই সব অকুতভয় কালজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস সংরক্ষণ অত্যান্ত জরুরি। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসীকতা,বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস পৌঁছে দিতে না পারলে সেটা হবে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা ও লজ্জার।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored