আমাদের পূর্বপুরুষরা একটা সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তাই প্রখ্যাত ৭২এর সংবিধানে লেখা হয়েছিলো “হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান সবাই আমরা বাঙালী”। সেনাধ্যক্ষ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে অনুধাবন করলেন যে বিষয়টায় কিছু একটা গোলমাল আছে, তাই তিনি জাতীসত্বার এক নূতন সমীরণ তৈরী করলেন- “হিন্দু+মুসলমান+খ্রিষ্টান+বৌদ্ধ= সবাই আমরা বাঙলাদেশী”। আর সে’দিনের পর থেকে কোনকিছুই আর অতীতের মতো থাকলো না, জাতীয়তার প্রশ্নে এই দেশ অনন্তকালের জন্য দু”ভাগে বিভক্ত হয়ে গ্যালো।
জিয়া খুব একটা ভুলও বলেননি। সমতলের প্রায় সবাই বাঙালী হলেও পাহাড়ে আছে চাকমা, মারমা, মুরং, গাড়ো, বম… তারাতো মংগোলীয় বংশোদ্ভূত, বাঙালীদের মতো ইন্দো-আর্য গোত্রীয় নাহ। তার উপর আছে সাঁওতালরা। জাতীয়তা যদি হয় “বাঙালী’ তাহলে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর কি এই দেশে কোন স্বীকৃতি নেই?
প্রশ্নটা সমুচিত কিন্তু যে জবাব সেনাধ্যক্ষ জিয়াউর রহমান বের করলেন তা ধ্বংসাত্মক। তিনি বলতে পারতেন যে বাঙালী অবাঙালী সবাই আমরা বাঙলাদেশী, বা বাঙালী-আদিবাসী সবাই আমরা বাঙলাদেশী। কিন্তু বিষয়টাকে তিনি জাতীগত আংগিকে সমাধান না করে ধর্মীয় আংগীকে করলেন- হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সবাই আমরা “বাঙলাদেশী”। অসাম্প্রদায়িকতার জায়গা দখল করে নিলো ইসলামী জাতীয়তাবাদ, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এক দেশ যেখানে শতকরা ৮৫ ভাগ নাগরিকই মুসলমান।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে ইতিমধ্যেই উল্লেখিত তিনটি ধর্ম, যথা হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানের সাথে চতুর্থ বৌদ্ধটা জুড়ে দিলেই তা কিভাবে অসাম্প্রদায়িক থেকে ধর্মভিত্তিকে পরিনত হয়ে যায়? এর উত্তর পাওয়া যাবে স্বাধীনতাপূর্ব বাঙলায় বা পূর্ব পাকিস্তানে। ভুললে চলবে না যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার মাধ্যমে কিন্তু বায়ান্নর ফেব্রুয়ারীতে বাঙালী তা মানতে অস্বীকার করলো এবং ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করে নিজের জাতীগত পরিচয়ের স্বীকৃতি দাবী করলো। বাঙালীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির এই সংগ্রামই ক্রমে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়েছে, ফলশ্রুতিতে ১৯৭১এ যখন এদেশ স্বাধীন হলো তা হয়ে দাঁড়ালো বাঙালীর দেশ!
বহু শতকের নিগ্রহ আর শোষণের শিকার বাঙালী তার মুক্তির উচ্ছাসে ভুলে গ্যালো ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠীগুলোর কথা, যারা এদেশেরই সন্তান। স্বাধীন বাঙলাদেশের জাতীয়তা নির্ধারণ করা হলো শুধুমাত্র বাঙালী নৃগোষ্ঠির কথা মাথায় রেখে এবং সংবিধানে উল্লেখ করা হলো যে ধর্মীয় কোন বিভাজন কাউকে আলাদা করবে না অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান যাই হোক না ক্যানো এদেশে সবার জাতীগত পরিচয় একই- “বাঙালী”।
কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়া শুধুমাত্র কোন একক নৃগোষ্ঠীর জন্য জাতীয়তা নির্ধারণ করেন নি। এদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মূলতঃ আদীবাসী নৃগোষ্ঠীগুলো, যাতে ১১টি পাহাড়ি জাতিসম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত।
স্পষ্টতই বিভাজনটা এখানে শুধুমাত্র ধর্মীয় ছিলো না, সবচেয়ে বড় বিভাজন ছিলো জাতিস্বত্বার। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়া সেই জাতীগত বিভাজনকে দূর করার চেষ্টা না করে ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারণ করলেন, বলা হলো যে ৪ ধর্মের মানুষ মিলেই এখন থেকে বাঙলাদেশী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, যদিও পাহাড়িদের মধ্যে সর্বপ্রাণবাদ বা প্রকৃতিপূজারীরাও একটি বৃহৎ অংশ যা জিয়ার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তাছাড়া সাঁওতালরা বৌদ্ধ বা পাহাড়ি না হলেও একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন নৃগোষ্ঠী। কিন্তু জাতীগত স্বীকৃতিকে এখানে বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ কর্তৃক পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করা হলো।
ইসলাম এদেশের ৮৫ ভাগ মানুষের ধর্ম, তো ইসলামের ভিত্তিতে জাতীয়তায় সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে এই যে একটা দেশের জাতীয়তা যখন ৮৫ ভাগ লোকের বিস্বাসের উপর ভিত্তি করে হয়, বাদবাকি ১৫ ভাগ লোক সেই দেশে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিনত হয়৷ সে তখন ঐ দেশে বসবাসের অধিকার ঠিকই পায় কিন্তু দেশটাকে নিজের বলার নৈতিক অবস্থান হারিয়ে অনেকটা নিজভূমে পরবাসীতে পরিনত হয়। বর্তমানে এদেশের জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম এবং রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে ইসলাম, সেক্ষেত্রে বাকি ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের স্থান ঠিক কোথায়?
য্যামন ইসরায়েল ঈহুদীদের জাতীয় নিবাস হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, তাই সেখানে অ-ঈহুদী আরবদের খুব সহজে গৃহহারা করা যায়, তাদের বহুপ্রজন্মের বসতী উচ্ছেদ করে তৈরী করা যায় ভিনদেশ হতে আগত ঈহুদীদের জন্য আবাসন। যেহেতু সেটা ঈহুদীরাষ্ট্র, একজন বিদেশী ঈহুদীরও অধিকার সেদেশের একজন স্থানীয় আরব থেকে বহুগুন বেশী।
ধর্মের নামে এদেশে সেনাপতি জিয়াউর রহমানও ঠিক এমনটাই করলেন। যেই বৌদ্ধদের জাতীস্বত্বার অধিকারের নামে তিনি দেশের জাতীয়তা বাঙালী বদলে বাঙলাদেশী করেছিলেন, সেই তাদেরকেই তিনি নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করলেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়ে মুসলমানদের আধিক্য বাড়াতে ট্রাক ভরে ভরে নদী ভাংগনের শিকার উদবাস্তু বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে গিয়ে বসতী স্থাপন করানো হলো পার্বত্য জেলাগুলোয়। ভাটি অঞ্চলের মুসলমান ভুমিহীনদের পুনঃর্বাসিত করার নামে তিনি পাহাড়ি আদিবাসীদের ভুমিহীন করলেন, কিন্তু তারাতো বৌদ্ধ, ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক!
ফলাফলে শুরু হলো ২১ বছরব্যাপী অধিকার আদায়ের সুদীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। যদিও সন্তু লারমাকে কেউ কখনো ইয়াসীর আরাফাতের সাথে তুলনা করেনি, বা শান্তিবাহিনীকে কেউ বাঙলাদেশের পিএলও বলে ডাকেনি, কিন্তু এই দুই সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি ছিলো অভিন্ন। ফিলিস্তিনে মুসলমানরা সংখ্যালঘু বলে ওদের যখন নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত করে ঈহুদী বসতী স্থাপন করা হয়, আমরা আহত বোধ করি কিন্তু বাঙলাদেশে আমরা নিজেরাই সংখ্যাগুরু হওয়ায় পাহাড়ের আদিবাসীদের তাদের ৪ পুরুষের ভূমি থেকে উৎখাত করে সমতল থেকে আগত বহিরাগত বাঙালী মুসলমানদের মাঝে বিলি করা হলে আমরা তাতে অন্যায় কিছু দেখি না। এটাই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বাস্তব রুপ।
বাঙালী মুসলমান সমাজ যাহোক সবকিছু ভুলে গিয়ে, দূর পাহাড়ের ঘটনাবলীকে উপেক্ষা করে নিজেদের নূতন জাতীয়তা অনুযায়ী বাঙলাদেশী হয়েই বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়লো। শত শত বা হাজার বছরের বাঙালীর গৌরবোজ্জল ইতিহাস বা সংস্কৃতি নিয়ে তার আর ত্যামন কোন মাথাব্যথা রইলোনা।
শুধুমাত্র আজও বাগদাদ হোক বা বুসান, মষ্কো হোক বা মেলবোর্ন, তথাকথিত ‘বাঙলাদেশীরা’ কোন ভুল করলেই অপর জাতীর লোকেরা নাক সিঁটকিয়ে বলে হুমম্ “বা..ং..গা…লী!” যে জাতী নিজের গৌরবজ্জ্বল কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করেছে, অপরের সামনে সে কি নিয়ে দাঁড়াবে? তাকে তো মাথা নীচু করে একথা শুনতেই হবে, যে সে মূল্যহীন।