মানবেতিহাসের নানা তাৎপর্যময় ঘটনার সাক্ষী এই মাস। ইসলামপূর্ব আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজেও মহররম মাসের বিশেষ মর্যাদা ছিল। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত পবিত্র চার মাসের অন্যতম মহররম।
ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই মাসগুলোর গণনা আল্লাহর কাছে বারো মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বিন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজদের ওপর কোনো জুলুম কোরো না। সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬
আয়াতে আল্লাহর বাণী তোমরা এতে নিজেদের ওপর কোনো জুলুম কোরো না’ বাক্যটি প্রমাণ করে এ সময়ে সংঘটিত অন্যায় ও অপরাধের পাপ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি ও মারাত্মক।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তোমরা এতে নিজেদের ওপর কোনো জুলুম কোরো না’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ বারো মাসের কোনোটিতেই তোমরা অন্যায় অপরাধে জড়িত হয়ো না।
অতঃপর তা হতে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেছেন। এসব মাসে সংঘটিত অপরাধকে অতি মারাত্মক বলে গণ্য করেছেন। আর তাতে সম্পাদিত নেক আমলকে বেশি সওয়াবযোগ্য নেক আমল বলে সাব্যস্ত করেছেন। কাতাদা (রা.) বলেছেন, যদিও অন্যায়-অবিচার সব সময়ের জন্য বড় অন্যায়, তবে হারাম মাস চতুষ্টয়ে সম্পাদিত জুলুম অন্যান্য সময়ে সম্পাদিত জুলুম হতে অপরাধ ও পাপের দিক থেকে আরো বেশি মারাত্মক অন্যায়। আল্লাহ তাআলা নিজ ইচ্ছামাফিক যাকে ইচ্ছা বড় করতে পারেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) মদিনায় এসে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবী (সা.) বললেন, এটি কী? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা (আ.) রোজা পালন করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং সাওম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৫
এটি সেই দিন যেদিন নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নুহ (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য সেদিন রোজা রেখেছিলেন।হাদিস : ৮৭১৭
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, জাহেলি যুগের লোকেরা আশুরার রোজ সাওম পালন করত।তুহফাতুল আশরাফ, হাদিস : ১২৭৩৬
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি নবী (সা.)-কে রোজা রাখার এত বেশি আগ্রহী হতে দেখিনি, যত দেখেছি এ আশুরার দিন এবং এ মাস (রমজান) মাসের রোজার প্রতি। সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৭
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আশুরার দিনের সাওমের ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৬
যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) সাওম রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়।
তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আগামী বছর এই দিন এলে আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাআল্লাহ।সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪৬
ইমাম শাফি, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেননা নবী (সা.) ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন আর ৯ তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।
আশুরার রোজার কয়েকটি স্তর রয়েছে : সর্বনিম্ন হচ্ছে কেবল ১০ তারিখের রোজা রাখা। এর চেয়ে উচ্চ পর্যায় হচ্ছে তার সঙ্গে ৯ তারিখের সাওম পালন করা। এমনিভাবে মহররম মাসের রোজার সংখ্যা যত বেশি হবে মর্যাদাও ততই বাড়তে থাকবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, রমজানের পর সর্বোত্তম সাওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম (মাসের সাওম)। সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৮২
আল্লামা মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন, হাদিসের বাহ্যিক শব্দমালা থেকে পূর্ণ মাসের সাওম বুঝে আসে। তবে নবী (সা.) রমজান ছাড়া আর কোনো মাসে পূর্ণমাস সাওম পালন করেননি, এটি প্রমাণিত।
হাদিসকে এই মাসে বেশি পরিমাণে রোজা পালন করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হবে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা আর আশুরার একটি রোজা রাখা মাকরুহ হবে না। আল্লামা ইবন হাজার হায়সামি রচিত তুহফাতুল মুহতাজ গ্রন্থে আছে, আশুরা উপলক্ষে ১০ তারিখ কেবল একটি রোজা রাখাতে কোনো দোষ নেই।
আশুরার দিন লোকেরা সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে। এ সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হলো, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না? উত্তরে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপন প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সহিহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবিদের থেকেও না।
চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এই ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ও সাহাবিদের থেকে কোনো সহিহ কিংবা দুর্বল হাদিসও বর্ণনা করেননি।
শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল মুনাজ্জিদের ফাদলু আশুরা ওয়াশ-শাহরিল মুহাররম অবলম্বনে