মধ্য এশিয়ার মুসলমান অধ্যুষিত এক মনোরম দেশ উজবেকিস্তান। বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে উজবেকিস্তানের সমুদ্রপথে যোগাযোগ নেই। কারণ দেশটিকে ঘিরে আছে স্থলভাগের পাঁচটি দেশÑ কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। কয়েক হাজার বছর আগে উজবেকিস্তান ইরানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
ইরান থেকে আসা এবং ইরানি ভাষায় কথা বলা মানুষের বসবাসের মধ্য দিয়েই দেশটিতে জনবসতি গড়ে ওঠে। পূর্ব ইউরোপের দক্ষিণ অংশ এবং চীন আর পশ্চিমে আফ্রিকার পূর্বভাগ এবং আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ বাণিজ্যিক পথ ‘সিল্ক রুট’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল।
এই পথ ধরে বাণিজ্যিক কাফেলার চলাচলের ইতিহাসও হাজার বছরের পুরনো। বিখ্যাত এই সিল্ক রুটের মধ্যভাগে রয়েছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যার অন্যতম উজবেকিস্তান। তাই বলা চলে উজবেকিস্তানে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হয় অতি প্রাচীনকাল থেকেই।
বিশ্ব বিজয়ী বীর এবং বিশ্বযুদ্ধের কুশীলবদের নানামুখী তৎপরতার নীরব সাক্ষী আজকের উজবেকিস্তান। এক সময় গ্রিকের শাসক বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার ও মঙ্গোলসম্রাট চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা উজবেকিস্তান দখল করেছিলেন।
ইরান ছাড়াও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নেরও অংশ ছিল এই দেশ। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে ১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট মস্কোতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দিনই উজবেকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরদিন ১ সেপ্টেম্বর দেশটিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান বিশ্বের ১১ নম্বরে। এ ছাড়াও এখনো মাটির নিচে রয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি, অপরিশোধিত তেল (কনডেনসেট) এবং মূল্যবান হাইড্রোকার্বন। কয়লা রুপার খনিও রয়েছে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই উজবেকিস্তান। তুলা উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের সপ্তম ও তুলা রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের পঞ্চম স্থানে রয়েছে উজবেকিস্তান। পর্যটনের জন্য দেশটির সুনাম রয়েছে বিশ্বে।
উজবেকিস্তানে রয়েছে ১২টি প্রদেশ, একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং পৃথক সত্তায় গড়ে ওঠা রাজধানী ‘তাসখন্দ’। উজবেকিস্তানের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ। ৪,৪৮,৯৮৭ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। নানাবিধ উপজাতি সম্প্রদায়, গোত্র, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বহু ভাষাভাষী মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে উজবেকিস্তান। দেশটির অর্থনীতি মূলত খনিজ সম্পদনির্ভর। বছরে দেশটি ৮০ টন স্বর্ণ উৎপাদন করে, যা বিশ্বের স্বর্ণ উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থান। তামা মজুদের ক্ষেত্রে দশম এবং ইউরেনিয়াম মজুদের ক্ষেত্রে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে উজবেকিস্তান
উজবেকিস্তানে ইসলামের উত্থান
উজবেকিস্তানের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের মধ্যে ৮৮ শতাংশ বা ৩ কোটির বেশি মুসলমান। সুফি ঘরানায় বিশ্বাসী ও সুন্নি মতাবলম্বী। সপ্তম শতকের শুরুতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ও মদিনায় একজন অনুকরণীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৬১০ সালে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং ৬৩০ সালে মক্কা বিজয় করে ইসলামের বাণী বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
৬৩২ সালে তার মৃত্যুর পর ইসলামের চার খলিফা যথাক্রমে হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.) এবং হজরত আলীর (রা.) শাসন চলে ৬৬১ সাল পর্যন্ত। এ সময় ইসলামের বার্তা নিয়ে সাহাবি এবং অন্য ধর্ম প্রচারকগণ দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েন। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সৌদি আরব থেকে স্থলপথে ধর্ম প্রচারকগণ ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুর্কিস্তান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরে তা ক্রমে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ সমগ্র উজবেকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। ৮১৯ থেকে ৮৯৯ সাল পর্যন্ত ইরানে সামানিদ বংশের শাসন চলে। সুন্নি মতাবলম্বী সামানিদ বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের বাণী ও সামানিদ শাসনের পরিধি যুগপৎভাবে আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ও জনপদে বিস্তার লাভ করে, যা উজবেকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ সামারখন্দ।
আমির তিমুরের অমূল্য অবদান
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে মধ্য এশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘তিমুরিদ’ বংশের শাসন। এই মুসলমান বংশের প্রতিষ্ঠাতা আমির তিমুর আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, উজবেকিস্তানসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মধ্য এশিয়া বিশেষত উজবেকিস্তানের স্থানীয় পর্যায়ের বহু নেতা ইসলাম গ্রহণ করেন। তিমুর নিজে তার আমলের মুসলমান বিদ্যান ব্যক্তিদের অত্যন্ত সমাদর করতেন। তিনি সুন্নি মতবাদ ও সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
তার আমলে মুসলমানদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, চিকিৎসা, দর্শন আবিষ্কার প্রভৃতি এক স্বর্ণযুগ অতিক্রম করে, যার নীরব সাক্ষী উজবেকিস্তানের সমরখন্দ। ভারতবর্ষ জয়ের পর আমির তিমুর তার নতুন রাজধানী সমরখন্দে আসেন এবং তৎকালীন মুসলমান বিশ্বের অন্যতম সুন্দর এবং বৃহত্তম ‘বিবি খানম মসজিদ’ নির্মাণ করেন।
হজরত কুসম ইবনে আব্বাসের (রা.) উজবেকিস্তানে ইসলাম প্রচার
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মের মাত্র দুই বছর আগে জন্মেছিলেন তারই চাচা হজরত আব্বাস ইবনে মুতালিব (রা.)। প্রথম জীবনে তিনি ইসলাম গ্রহণ না করলেও নিজ বংশের সন্তান এবং আপন ভাইয়ের এতিম ছেলে হিসেবে মহানবীকে (সা.) সব সময় নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন।
বদরের যুদ্ধের পর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করেন। তারই সুযোগ্য সন্তান হিসেবে হজরত কুসম ইবনে আব্বাস (রা.) ইসলামের বাণী নিয়ে সপ্তম শতকে উজবেকিস্তানে পৌঁছেন এবং তৎকালীন শাসকসহ সবার মাঝে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেন। জন্মের পর অল্প কিছুদিন হজরত কুসম ইবনে আব্বাস (রা.) সচক্ষে মহানবীকে (সা.) দেখার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে তিনি পরবর্তীতে ইসলামের বাণী নিয়ে উজবেকিস্তানে আসেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে উজবেকিস্তানে অবস্থান করেন বলে নিশ্চিত তথ্য জানা যায়। বর্তমানে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে তার সমাধি থাকার কথা বিশ্বাস করে অনেক মুসলমান স্থানীয় স্মৃতিসৌধে ভিড় জমান।
ইসলামের স্বর্ণযুগে ৯৭৩ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের সীমান্তবর্তী শহর ‘বিরুনি’তে জন্মগ্রহণ করনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ আবু রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহাম্মদ আল বিরুনি (সংক্ষেপে আল বিরুনি)। জীবনের প্রথম ২৫ বছর তিনি স্থানীয়ভাবে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা, ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ, অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, দর্শন, পদার্থবিদ্যা ও অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়ক শাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন বিষয়ে তার বই লেখার অবিরাম সংগ্রাম। স্থানীয় একাধিক রাজা-বাদশার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি শতাব্দীর ইতিহাস ও ঘটনাপঞ্জি নিয়ে বেশ কিছু বই লিখে সবার নজর কাড়েন। এর মধ্যে বর্তমান আফগানিস্তানের গজনির প্রখ্যাত শাসক ও গজনি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ (গজনি মাহমুদ) তাকে সম্মানের সঙ্গে নিজের রাজধানী গজনিতে নিয়ে যান এবং রাজকীয় জ্যোতিষী নিযুক্ত করেন। ৪৪ বছর বয়সে আল বিরুনি গজনির শাসক মাহমুদের সঙ্গে ভারত অভিযানে অংশ নেন এবং ভারতের ওপর ব্যাপক গবেষণা ও লেখালেখি করেন। এ সময় তিনি ছায়াঘড়ির মতো সূর্যের অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা যে কোনো অপরিবর্তিত স্থানের সঠিক অবস্থান, দিনের সময় প্রভৃতি নির্ণয়ে সহায়তা করত। এ আবিষ্কারের পেছনে ছিল ইসলাম ধর্মের নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক সময়ে নামাজ আদায়, সাহরি ও ইফতারের সময় অনুধাবন এবং কাবার অবস্থান বা দিক নির্ণয় করে সঠিকভাবে কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায়, মসজিদ ও ঈদগার দিক নির্বাচন, সঠিক দিক বিবেচনা করে মৃত ব্যক্তির সমাহিত করা ইত্যাদি।
অংক ও জ্যোতির্বিদ্যায় আল বিরুনির বিশেষ আগ্রহ ছিল। এর মধ্যে জ্যামিতি নিয়ে তিনি চিরস্মরণীয় বহু কাজ করে গেছেন। তার সুপরিচিত ১৪৮টি বইয়ের মধ্যে ৯৫টি বই অঙ্ক ও জ্যোতির্বিদ্যাকে ঘিরে আবর্তিত। তার রচিত অঙ্ক শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যার নানা সমীকরণ সমাধানে বিশেষত তরল পদার্থের ঘনত্ব নির্ণয়ে সহায়ক ছিল। পাহাড়ে উচ্চতা মাপার বিশেষ কৌশল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মাপার ক্ষেত্রে সফল হন। আজ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা বিশেষত নভোযান ও স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর সঠিক ব্যাসার্ধ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮৪৭.৮ মাইল। অথচ পাহাড়ে উচ্চতাকে কেন্দ্র করে হাজার বছর আগে আল বিরুনি এই ব্যাসার্ধ ৩৯২৮.৭৭ মাইল বলে রায় দেন, যা মাত্র ২ শতাংশ বেশি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধের আবিষ্কারের নেপথ্যে আল বিরুনি রচিত ফার্মেসি বিষয়ক বইয়ের অবদান রয়েছে। পদার্থের ঘনত্ব ও বিশুদ্ধতা নির্বাচনে তার আবিষ্কার চিকিৎসা শাস্ত্রেও ওষুধ আবিষ্কারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মূল্যবান পাথর নির্বাচনে আগে কেবল পাথরের রং বিবেচনা করা হতো। অথচ ইবনে সিনা ঘনত্ব ও শক্তি (হার্ডনেস) নির্ধারণ করে পাথরের যথাযথ মান ও গুণাগুণ বোঝার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান অর্জনের অগ্রপথিক ছিলেন আল বিরুনি। বর্তমান যুগের ড. জাকির নায়েকের মতো সেই আমলে আল বিরুনি ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইহুদিসহ নানা ধর্মের ওপর অগাধ জ্ঞান রাখতেন এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে সঠিক বাণী উল্লেখ করে সবাইকে চমকে দিতেন।
প্রতœতত্ত্ব বিশেষত ভারতে প্রতœতত্ত্ব নিয়ে আল বিরুনির লেখা পৃথিবীর মূল্যবান সম্পদ। সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে তিনি ভারতীয় সাধারণ জনগণের জীবনাচার, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে অসংখ্য লেখা রচনা করেন। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে তিনি অবিরাম লিখে গেছেন। তার রচনা বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ১২টি শাখায় চর্চা করা হয়। দীর্ঘ ৭৭ বছর বেঁচে ছিলেন এই জ্ঞান তাপস। ১০৫০ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের গজনিতে মৃত্যুবরণ করেন আল বিরুনি এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মস্থান মক্কা থেকে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরে বর্তমান উজবেকিস্তানের সমরখন্দ এলাকার তিরমিজ নামক স্থানে জন্ম নেন মহান ইসলামী চিন্তাবিদ ও হাদিস সংগ্রহকারী মুহাম্মদ ইবনে ইসাআত তিরমিজি, সংক্ষেপে ইমাম তিরমিজি (রহ.)। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আরব জাহানের পথেপ্রান্তরে ঘুরে শুদ্ধ হাদিস সংগ্রহ করে অমর হয়ে আছেন তিনি। একদল গবেষক তাঁর জন্ম মক্কায় দাবি করলেও অধিকাংশের মতে তাঁর জন্ম বর্তমান উজবেকিস্তানে আনুমানিক ৮২৪-২৫ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষ অন্য দেশে বসতি স্থাপন করেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষত ইরান এবং ইরাকে সপরিবারে বসবাস এবং ইসলামী জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে ইমাম তিরমিজি (রহ.) এর শৈশব কাটে বলে জানা যায়। ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ভাষা, ব্যাকরণ ও বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন তিনি। তাই তার রচনা ভাষাগত ও ব্যাকরণগত শুদ্ধতার বিচারে অনন্য স্থান লাভ করেছে। তবে বিশুদ্ধ হাদিসের সন্ধানে তাঁর পথচলা শুরু হয় আনুমানিক ২০ বছর বয়সে। এই পথযাত্রায় তিনি বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ ইসলামী চিন্তাবিদ এবং হাদিস সংগ্রহকারীর সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ হাদিস এবং হাদিসের সূত্র বা পরম্পরার সন্ধান করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয় তৎকালে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ বসরা ও কুফা নগরে। শুধু কুফা নগরেই তিনি ৪২ জন ইসলামী আলেম ওলামা থেকে হাদিস সংগ্রহ করেন। এ ছাড়াও তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসেন আরেক হাদিস সংগ্রহকারী ইমাম বুখারি (রহ.)। ইতিহাস মতে, ইমাম তিরমিজি (রহ.) দীর্ঘ পাঁচ বছর ইমাম বুখারির (রহ.) সান্নিধ্যে ইরানের নিশাপুর অঞ্চলে অবস্থান করেন এবং সংগৃহীত হাদিসের বিশুদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত হন।
তাই ইমাম বুখারির (রহ.) প্রতি তিনি সর্বদা কৃতজ্ঞ ছিলেন। একটি হাদিস গ্রন্থে ইমাম তিরমিজি (রহ.) ১১৪ বার ইমাম বুখারির (রহ.) নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় তার দীর্ঘদিন হাদিসের সন্ধানের বিচরণের তথ্য রয়েছে। ইমাম বুখারি (রহ.) ছাড়াও তার শিক্ষা এবং কর্মজীবনে ইমাম আদ দারিমি (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.) এবং ইমাম দাউদের (রহ.) প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর সংকলিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে ৮টি গ্রন্থ বিশেষভাবে সমাদৃত। তবে তার সংকলিত বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ‘সামাইম মোহাম্মদিয়া’ অথবা ‘সামাইল আততিরমিজি’ অথবা জামি আততিরমিজি’ ইসলামী বিশ্বে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তার সংকলিত ৩ হাজার ৯৬২টি হাদিস শুদ্ধতার নিরিখে বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
৮৭০ সালে ইমাম বুখারি (রহ.) মৃত্যুবরণ করলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ইমাম তিরমিজি (রহ.)। দীর্ঘদিনের সঙ্গী, পরামর্শক ও শিক্ষক ইমাম বুখারির (রহ.) শোকে প্রায়ই কান্নœাকাটি করতেন ইমাম তিরমিজি (রহ.)। এ ছাড়াও পরকালের চিন্তা ও আল্লাহর ভয়েও কেঁদে বুক ভাসাতেন তিনি। শেষ জীবনে তিনি কিছুই চোখে দেখতেন না। তাই তাঁকে অনেক গবেষক ‘লাকাব’ বা ‘আজ জারির’ উপাধি দেন, যার অর্থ দৃষ্টিহীন। অনেকেই আবার তাঁকে জন্মান্ধ বললেও ইতিহাস তা সমর্থন করে না। নিজ জীবনে তিনি যেমন কেঁদেছেন, তেমনি অসংখ্য ভক্ত ও শিষ্যদের কাঁদিয়ে ৮৯২ সালের ৯ অক্টোবর পরকালে পাড়ি জমান ইমাম তিরমিজি (রহ.)। জীবনের শেষভাগে তিনি নিজ জন্মস্থান উজবেকিস্তানের তিরমিজে ফেরত আসেন এবং ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত হন। এখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর তিরমিজ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে শিরাবদ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়। বর্তমানে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ১৯৯০ সালে তাঁর জন্মের ১২০০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হয় এই স্মৃতিসৌধে।
ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আল বুখারি (রহ.)
সুফি মতবাদে বিশ্বাসী মুসলমানদের কাছে হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ‘সহি আল বুুখারি’ নামক হাদিস গ্রন্থ। এই গ্রন্থের হাদিস সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ইমাম আল জুফি আল বুখারি। ৮১০ সালের ২১ জুলাই বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা অঞ্চলের রাজধানী বুখারা শহরে জন্ম নেন ইমাম বুখারি। তার বাবা ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিমও ছিলেন একজন হাদিস সংগ্রহকারী। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি অসংখ্য হাদিস মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর তিনি বাবাকে হারান এবং ১৬ বছর বয়সে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন। এরপর মক্কায় বসেই শুরু হয় তার হাদিস নিয়ে সাধনা। কথিত আছে বিশুদ্ধ হাদিসের সন্ধানে তিনি সে আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ বহু অঞ্চলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রায় ১০০০ ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদের কাছ থেকে প্রায় ৬ লাখ ইসলামী রীতিনীতি, ফতোয়া, মতবাদ ও হাদিস সংগ্রহ করেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির কল্যাণে তিনি প্রথম জীবনে প্রায় ৭০ হাজার এবং শেষ দিকে প্রায় ৩ লাখ হাদিস মুখস্থ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। হাদিস শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ইমাম আহাম্মদ বিন হানবাল (র.)-এর কাছে বিশেভাবে ঋণী ছিলেন। তার কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নেওয়া ছাত্রের সংখ্যা নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন। তবে ধারণা করা হয় যে, কমপক্ষে ৯০ হাজার ছাত্র ও অনুসারী তার কাছে হাদিস শিখতে এসেছিলেন। বিশুদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তিনি প্রথমে হাদিস বর্ণনাকারীর জীবন, আচরণ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করতেন এবং পরবর্তীতে তার কাছে যাবেন কি না সে সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি প্রতিটি হাদিস মক্কা বা মদিনা শরিফে বসে লিখতেন এবং হাদিস লেখার আগে নফল নামাজ পড়ে বিশুদ্ধ হাদিস
লেখার শক্তি কামনা করতেন। অসংখ্য হাদিস মুখস্থ করলেও ১৬ বছরে তিনি ৬টি খ-ে প্রায় ৭২৫২টি হাদিস লিখেছেন বলে জানা যায়। শেষ জীবনে তিনি আবারও উজবেকিস্তান নিজ জন্মভূমি বুখারায় ফেরত আসেন এবং একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তৎকালীন শাসক এই মাদ্রাসায় নিজ পুত্রকে পৃথকভাবে পড়াতে বললে তিনি তা অস্বীকার করেন। ফলে বুখারা ছেড়ে তাকে ৩০ মাইল দূরের এক দুর্গম গ্রামে আশ্রয় নিতে হয়। শেষ জীবনে তিনি তার সব পৈতৃক সম্পত্তি দান করে দেন। এ সময় দিনে ২-১টি পেস্তা বাদাম খেয়েও তার দিন অতিবাহিত হয়। ৬২ বছর বয়সে ৮৭০ সালে খারতাঙ্ক নামক সেই দুর্গম গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে এখানে স্মৃতিসৌধ, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়।
অসাধারণ চিকিৎসক ইবনে সিনা
চিকিৎসা শাস্ত্রের অন্যতম দিকপাল আবু আলী হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা (সংক্ষেপে ইবনে সিনা)। ৯৮০ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা অঞ্চলের আফসান গ্রামে বাবা আবদুল্লাহ ও মা সিমারার কোলজুড়ে জন্ম নেন ইবনে সিনা। মাত্র ১০ বছর বয়সে কোরআন শরিফ মুখস্থ করে তিনি তার প্রখর স্মৃতিশক্তি ও প্রতিভার জানান দেন। এক ভারতীয় প-িতের হাতে তার অঙ্গে হাতেখড়ি ঘটে এবং তৎকালে যারা চিকিৎসা বা রোগীর সেবা করতেন, তাদের সান্নিধ্যেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মুসলমান হিসেবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় বিশেষত ইসলামী বিচার ব্যবস্থা বা শরিয়া আইন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। দর্শন শাস্ত্রেও তার আগ্রহ ছিল। তিনি ছিলেন প্রখর জ্ঞান পিপাসু। কথিত আছে অ্যারিস্টটলের একটি বই তিনি বোঝার জন্য ৪০ বার পড়েছিলেন এবং কোনো কোনো বই পড়তে পড়তে বইয়ের অক্ষরগুলো মুছে গিয়েছিল। ১৬ বছর বয়সে চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চায় তিনি বিশেষভাবে মনোযোগ দেন এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি একজন সুচিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পান। দিনভর তিনি বিনাপয়সায় রোগী দেখতেন এবং অজু করা অবস্থায় রাতভর লেখাপড়া করতেন। সুনামের কারণে তৎকালে ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে গঠিত তৎকালীন সামাদিন সাম্রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হন এবং সাম্রাজ্যের আমির ৯২ বছর বয়সী নুহুকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পেতে সহায়তা করেন। ১০০৪ সালে সামাদিন সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে তিনি এক বিরূপ পরিবেশে যাযাবরের মতো বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে বেড়ান। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর এই প্রতিকূল অবস্থার অবসান ঘটে এবং তিনি তৎকালীন বৃহত্তর পারস্য (ইরান) অঞ্চলের শাসক মোহাম্মদ ইবনে রুস্তম দুশমানজিয়ার চিকিৎসক এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। শেষ জীবনে পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে তিনি ধর্ম চর্চায় মন দেন। সব সম্পদ গরিবদের দান করেন ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দেন। এ সময় প্রতিদিন তিনি একবার কোরআন খতম করতেন বলে জানা যায়। ১০৩৭ সালের জুন মাসে পবিত্র রমজান মাস চলাকালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ইবনে সিনার মৃত্যু ঘটে। ইরানের হামদানে তাকে সমাহিত করা হয়।
ইবনে সিনা মৃত্তিকা বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা ও কাব্যসাহিত্য বিষয়ে বহু বই লিখেছেন। তবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনার নাম ‘আল কানুন ফিত্বিব’, ‘দি ক্যানন অব মেডিসিন’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। এই বই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিকোষ বা ইনসাইক্লোপিয়া হিসেবে সমাদৃত। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো ‘এই দুনিয়ার লোকেরা দুই দলে বিভক্ত। এক দলের ধর্ম নেই কিন্তু বুদ্ধি আছে। আরেক দলের ধর্ম আছে, কিন্তু বুদ্ধি নেই।