আগামীকাল ২২মার্চ পালিত হবে পবিত্র শবে মেরাজ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এ রাতে অলৌকিকভাবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ঊর্ধ্বাকাশে গমন করে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন পৃথিবীতে ফিরে আসেন। জিকির-আসকার, নফল নামাজ, দোয়ার মধ্য দিয়ে শবে মেরাজের রাত অতিবাহিত করেন মুসলমানরা।
নবুওতের পঞ্চম বছর নবীজির জীবনের একটি তাৎপর্যবহ কাল। এ বছর তাঁকে এমন দুটি বর্ণাঢ্য সম্মানে সম্মানিত করা হয়, যা নানা বিচারে গুরুত্বপূর্ণ;—ইসরা ও মেরাজ হলো সেই দুটি অভাবিত সম্মাননা। ইসরা একটি বিস্ময়কর ভ্রমণপর্বের নাম, যার ব্যাপ্তি এই পার্থিব জগতের সীমায় সীমিত। এই ভ্রমণের আরেকটি পর্ব রয়েছে, যার সীমারেখা এই পার্থিব জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তার নাম মেরাজ। এখানে আমাদের আলোচ্য, ইসরা।
এক রজনীতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার হাতিমে শায়িত ছিলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল আলাইহিস সালাম আগমন করে বললেন, ‘আমাদের সাথে চলুন।’ একটি অদ্ভুত জন্তু তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলো;—এটি ছিলো একটি জান্নাতি বাহন। নবীজিকে বোরাকে আরোহণ করানো হলো; যার গতি এতই দ্রুত ছিলো যে, জন্তুটি যেখানে চোখ ফেলতো, সেখানে গিয়েই ওর কদম পড়তো। এমনই দ্রুত গতিতে তাঁকে প্রথমে সিরিয়ার আল-আকসা মসজিদে নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলগণকে নবীজির সম্মানে সমবেত করেছিলেন। এখানে পৌঁছে হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আজান দিলেন। সকল নবী-রাসূলগণ কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সকলে এই অপেক্ষায় ছিলেন, যে, ইমামতি কে করবেন? হযরত জিবরাঈল আমিন নবীজির হাত মোবারক ধরে তাঁকে ইমামতির জন্য এগিয়ে দিলেন। তিনি সকল নবী-রাসূল ও ফেরেশতাগণের নামাযের ইমামতি করলেন।
এ পর্যন্ত ছিল পার্থিব জগতের সফর, যা তিনি বোরাকে আরোহণ করে পাড়ি দিয়েছিলেন—দুটি ভ্রমণপর্বের এই পর্বকে ইসরা বলে। এরপর তিনি এই দুনিয়ার বাইরের বিস্ময়কর মণ্ডলি ভ্রমণ করেন, সে পর্বের নাম মেরাজ। ইসরা ও মেরাজের বিস্ময়কর পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি যখন দুনিয়াতে ফিরে আসেন, তখন তাঁর এই ভ্রমণ মক্কায় নানাবিধ সাড়ার আবহ তৈরি করে। এখানে ইসরা-সম্পর্কিত বিষয়াবলির উপরে যৎকিঞ্চিৎ বলা হবে।
সকালবেলা কুরাইশদের মধ্যে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত অবস্থা সৃষ্টি হয়। কেই হাততালি দিতে থাকে, আবার কেউ হতবাক হয়ে মাথায় হাত রাখে; আর কেউ কেউ বিদ্রূপের হাসি হাসতে থাকে। তারপর পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সবাই নবীজিকে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে। তারা জানতে চায়, ‘আচ্ছা বলো দেখি, বাইতুল মুকাদ্দাসের নির্মাণশৈলী কেমন আর তা পাহাড় থেকে কত দূরে অবস্থিত? এমনকি, তাদের জিজ্ঞাসার বিষয় থেকে মসজিদে আকসার জানলা-কপাট কতটি, সেরকম প্রশ্নও বাদ যায় না। বলা বহুল্য যে, এ সকল বিষয় কেউ গণনা করে রাখে না। নবীজি খুবই অস্বস্তি অনুভব করলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো ভিন্নরকম। তখনই মোজেযাস্বরূপ মসজিদে আকসাকে নবীজির সামনে তুলে ধরা হয় আর তিনি সবকিছু গুনে-গুনে বলতে থাকেন। এমনিভাবে তারা আরও বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে আর নবীজি সেগুলোরও উত্তর দিতে থাকেন। কুরাইশরাও সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো এবং বলতে লাগলো যে, ‘মসজিদে আকসার বর্ণনা অবস্থা ও বিবরণ তো তিনি ঠিকঠিকই বর্ণনা করে দিলেন!’
তারপর তারা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ করে বললো, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মুহাম্মদ এক রাতে মসজিদে আকসায় পৌঁছে পুনরায় ফিরে এসেছেন?’ হযরত আবু বকর উত্তরে বললেন, ‘আমি তো এর চেয়েও বিস্ময়কর বিষয়ে তাঁকে বিশ্বাস করি। যেখানে সকাল-সন্ধার সামান্য ব্যবধানে আসমানি সংবাদসমূহ তাঁর কাছে পৌঁছে যায়, সেখানে এই সামান্য ব্যাপারে কি সংশয় হতে পারে?’ এ কারণেও তাঁর উপাধি ‘সিদ্দিক’ হয়।
এছাড়াও, নবীজি ইসরা ও মেরাজ শেষে যখন বোরাকে করে পৃথিবীতে—তাঁর শহর মক্কা মোয়াজ্জামার দিকে ফিরে আসেন, পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে কুরাইশদের তিনটি বাণিজ্যিক কাফেলার পাশ দিয়ে তিনি অতিক্রম করেন। এদের কোনো কোনো ব্যক্তিকে তিনি সালামও করেন। তাঁরা নবীজির কণ্ঠ চিনতে পারে এবং মক্কায় ফিরে আসার পর এর সাক্ষ্যও প্রদান করে।
হাদিস ও সাহাবিদের বর্ণনা অনুযায়ী, মেরাজের রাতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.) নিয়ে কাবা শরিফের হাতিমে যান। জমজমের পানিতে অজুর পর বোরাক নামক বাহনে জেরুজালেমের বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এরপর প্রথম আকাশে পৌঁছান মহানবী (সা.)। সেখানে হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এভাবে সাত আকাশ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সাক্ষাৎ করেন হজরত ঈসা (আ.), হজরত ইয়াহইয়া (আ.), হজরত ইদ্রিস (আ.), হজরত হারুন (আ.), হজরত মুসা (আ.) এবং হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে।
সপ্তম আকাশ থেকে সিদরাতুল মুনতাহায় গমন করেন মহানবী (সা.)। সেখান থেকে আরশে আজিম যান। এক ধনুক দূরত্ব থেকে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয় মহানবী (সা.)-এর উম্মতদের জন্য।
মেরাজ শেষে পৃথিবীতে ফিরে রাসুল (সা.) পুরো ঘটনা হজরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে বর্ণনা করেন। তিনি নিঃসংশয়ে তা বিশ্বাস করেন। রাসুল (সা.) তাকে সিদ্দিকী বা বিশ্বাসী খেতাব দেন। মক্কার কাফেররা রাসুলের মেরাজের ঘটনাকে অবিশ্বাস করে।
তথ্য সূত্রঃ নবীজি ম্যাগাজিন।
লেখকঃমোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।