বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করেছে।
এর ফলে বঙ্গোপসারে হাই প্রোফাইল প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল। এই বন্দরটি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উচ্চাভিলাষ বাড়িয়ে দিত।
দৃশ্যত, পরিবেশগত উদ্বেগই বাংলাদেশ সরকারকে এই প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হতো বলে মন্ত্রি পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এর বদলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হবে মাতারবাড়িতে। এটি সোনাদিয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বলে তিনি জানান।
পরিবেশগত ইস্যু ছাড়াও ভূরাজনৈতিক কারণেও সম্ভবত বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে ভারত-চীন প্রতিযোগিতার কারণেও এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকতে পারে।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ধারণাটি প্রথমে পাওয়া যায় ২০০৬ সালে। চীন সেখানে একটি বন্দর নির্মাণ ও এই প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার চীন সফরে সময় এনিয়ে একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে সই হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
চীনের অব্যাহত আগ্রহ সত্ত্বেও ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালেও এটি এজেন্ডাভুক্ত হয়নি।
গত ছয় বছরে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বারবার বলে আসছেন যে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সরকার কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিলের কথা ঘোষণা করেনি।
তারপর আগস্টের শেষ দিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে হাসিনা সরকার সোনাদিয়া ডিপ সি পোর্ট অথোরিটি অ্যাক্ট ২০১২ বাতিল করার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে গভীরভাবে আগ্রহী ছিল। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দুটি কেবল ঘিঞ্চিই নয়, অগভীরও। ফলে বড় বড় জাহাজ এখানে ভিড়তে পারে না। এ কারণে শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুর থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের ব্যবস্থা করতে হয়। ওইসব বন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে খরচ ও সময় দুটিই বাড়ে।
একটি গভীর সমুদ্রবন্দর দুটিই কমাতে পারে। তাছাড়া এটি ভুটান ও নেপালের মতো ভূবেষ্টিত দেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, চীনের ইউনান প্রদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান এক কাজের জন্য সোনাদিয়াকেই সবচেয়ে ভালো অবস্থান হিসেবে বাছাই করে।
তাহলে কেন বাংলাদেশ প্রকল্পটি বাতিল করল? খবরে প্রকাশ, সোনাদিয়া প্রকল্পে চীনা সম্পৃক্ততায় আপত্তি করেছিল ভারত। কারণ স্থানটি ভারতের খুব কাছে।
ভারত এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও চীন ঋণ পরিশোধ না করতে পারায় চাপ দিতে পারে বন্দরটি তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। আর তেমনটি ঘটলে তা ভারতের নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অবশ্য ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বেশ সতর্ক। প্রকল্প গ্রহণে বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, এমন চীনা প্রকল্প গ্রহণ করে ভারতকে রাগাতে চায় না বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সতর্ক অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে। এককভাবে কোনো দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা গ্রহণ করছে। ফলে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলেও একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ চীনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন অনেক দেশের সাথেও সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দর এখন জাপানি সহায়তায় নির্মাণ করা হবে। সোনাদিয়ার মতো এটিও ভারতের কাছে বঙ্গোপসাগরে নির্মিত হবে। অবশ্য ভারত-জাপান দৃঢ় সম্পর্ক থাকার প্রেক্ষাপটে এখন ভারত সম্ভবত আপত্তি উত্থাপন করবে না। ইতোমধ্যেই বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০২৫ সাল নাগাদ তার প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর পেয়ে যাবে। তবে তা চীনের নয়, বরং জাপানের তহবিলে হবে।
সাউথ এশিয়ান মনিটর