রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সহযোগিতার তহবিল গঠনের সম্মেলনে সংকট সমাধানের জোরালো তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ওই ভার্চুয়াল সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব তাদের উৎস দেশ মিয়ানমারে ফিরতে হবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান শুধু প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই সম্ভব। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য যে প্রস্তাবগুলো দিচ্ছে, ঠিক একই ধরনের প্রস্তাব মিয়ানমারে দেওয়া ও বাস্তবায়িত না হলে এসব বিনিয়োগ ভেস্তে যাবে।
প্রতিমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেন, সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষা প্রশ্নে বাংলাদেশ যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়া দেওয়া হচ্ছে।
ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হবে বলে জোর দিয়ে জানান তিনি।
শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ কাঠামো ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের ভবিষ্যতের সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা আছে, তারা যেন সেই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে সংকট সমাধান করতে মিয়ানমারকে বোঝায় বা বাধ্য করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) আয়োজিত ওই ভার্চুয়াল সম্মেলন শুরুতে ছিল দাতা সম্মেলন।
বাংলাদেশের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনের শিরোনাম ঠিক করা হয় রোহিঙ্গা শরণার্থী সাড়াদানের জন্য টেকসই সহযোগিতা।
১০০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত ওই সম্মেলন গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ওই সম্মেলনে প্রায় ৬০ কোটি ডলার সহায়তার আশ্বাস মেলে।
এটি এ বছরের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার আওতায় প্রতিশ্রুত তহবিলের অতিরিক্ত। সম্মেলনে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈশ্বিক সহানুভূতির পাশাপাশি সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি, প্রত্যাবাসন ও তাদের ওপর নিপীড়নের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কাজ করার অঙ্গীকার মিলেছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন অনেকে।
সম্মেলনের আয়োজকরাসহ অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের মহানুভবতা ও উদারতার প্রশংসা করেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ভয়ংকর বর্বরতার শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব যখন কেউ নিতে চাচ্ছিল, না তখন একমাত্র দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন বাঁচিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশ যখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে সাগরে ঠেলে দিচ্ছিল, তখনো বাংলাদেশ তাদের উদ্ধার করেছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এর সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে।
তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
শাহরিয়ার আলম বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখায় ওই দেশটি আরো শক্তিশালী হয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন ই বিগান রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে এথনিক ক্লিনজিং জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ভয়ংকর ওই নিপীড়ন যারা করেছে তাদের আমরা অবশ্যই জবাবদিহি করাব এবং এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করব।
রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারে পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রের সবার ইস্যু। রোহিঙ্গাদের জন্য বর্তমান সহযোগিতার বাইরে আরো ২০ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
গতকাল যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের জন্য পৌনে পাঁচ কোটি পাউন্ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রী লর্ড তারিক আহমদ বলেন, এটি একটি মানবিক সংকট ও মানবাধিকার বিপর্যয়। এ সংকটের সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। আর এটি নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব মিয়ানারের।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরার অনুকূল পরিবেশ মিয়ানমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এই সংকটের আঞ্চলিক সমাধান প্রয়োজন। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।
সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার জ্যানেন লেনার্সিক বলেন, পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
ইইউয়ের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯ কোটি ৬০ লাখ ইউরো দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
সম্মেলন শেষে টেলিফোনিক প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রিচার্ড অলব্রাইট, যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী লর্ড তারিক আহমদ, সংকট ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার জ্যানেন লেনার্সিক ও ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্যাসিফিক ব্যুরোর পরিচালক ইন্দ্রিকা রাতওয়াতে।
আপনারা কি জবাবদিহি ও প্রত্যাবাসনের চেয়ে মানবিক সহায়তার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন? আপনারা কি মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশকেই বেশি চাপ দিচ্ছেন?
জবাবে তাঁরা বলেন, শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তার ওপর তাঁরা জোর দিচ্ছেন।
সংকটের সমাধান, প্রত্যাবাসনে সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যও তাঁরা কাজ করছেন। এর পাশাপাশি জবাবদিহিতা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতসহ (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে) অন্যান্য বিচারিক উদ্যোগে সহায়তা দিচ্ছেন।
মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের ওপরও তাঁরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। বাংলাদেশ, মিয়ানমার দুই জায়গাতেই তাঁরা কাজ করছেন।
ইন্দ্রিকা রাতওয়াতে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক। এই সমস্যার সমাধান আঞ্চলিকভাবেই করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রিচার্ড অলব্রাইট আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান মিয়ানমার সরকারকেই করতে হবে।
ব্রিটিশ মন্ত্রী লর্ড তারিক আহমদ বলেন, মিয়ানমারের দুই জেনারেলের ওপর যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদেও যুক্তরাজ্য কাজ করছে।
সংকট ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার জ্যানেন লেনার্সিক বলেন, শুধু মানবিক সহায়তা যথেষ্ট নয়। টেকসই সমাধানের ওপর জোর দিতে হবে।