করোনার প্রভাব২৫০ গারো পরিবারের দিন কাটছে অনাহরে

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

ময়মনসিংহের গজারিচালার একটি গারো পরিবার- সমকাল
ময়মনসিংহের গজারিচালার একটি গারো পরিবার- সমকাল

পাঁচ সন্তানের বাবা রণেশ সাংমার এক চোখ নষ্ট, আরেক চোখ প্রায় অন্ধ হওয়ার পথে। সন্তানরা ৮০ বছরের বৃদ্ধ এই বাবাকে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে গেছে অনেক বছর আগে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর খুকি মারাককে বিয়ে করেন তিনি। গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে সংসার চালান খুকি। তার এক মেয়ে লিপি মারাক মাকে ছেড়ে চলে গেছে। সারাদিন মানুষের কাছ থেকে চেয়ে এনে যা পান, তাই দিয়ে দু’বেলা খেয়ে-না খেয়ে চলে হতদরিদ্র এ দু’জনের। এখন করোনার প্রভাবে কেউ ভিক্ষাও দিচ্ছে না। ঘরে খাবার নেই, নেই একটা চালও। বৃদ্ধ রণেশ ক্ষুধার তাড়নায় ডুকরে কাঁদছেন শিশুর মতো। পাকের ঘরে নিভে যাওয়া উনুনে পড়ে আছে ভাতের শূন্য ডেকচি। ক্ষুধা যে মানতে চায় না কোনো কিছুই।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এবং মধুপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম গজারিচালায় প্রায় ৬০টি ঘরে গারো সম্প্রদায়ের ৬০০ আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর বাস। ফরেস্ট অফিসের উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করা ওই ভিটেমাটি ছাড়া সম্বল বলতে আর কিছু নেই তাদের। মুসলমানের জমিতে কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করে এরা। করোনাভাইরাসের কারণে এখন তাও বন্ধ। গ্রামে বিরাজ করছে আতঙ্ক, অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে বহু আদিবাসী পরিবারকে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি এ গ্রামে। গণসচেতনতার অংশ হিসেবে কোনো স্বাস্থ্যবার্তা কিংবা স্যানিটাইজেশনের বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের রেশও দেখা যায়নি পুরো গ্রামে। সাধারণ রোগবালাইয়ে এ গ্রামের মানুষকে যেতে হয় বহু দূরের হাসপাতাল কিংবা কবিরাজের কাছে। এখন করোনার কারণে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছে না আদিবাসী পরিবারগুলো।

রণেশ সাংমা অশ্রুশিক্ত হয়ে বলেন, ‘আনারস ক্ষেতে কাম করতে গিয়া ধারালো পাতার খোসা লাইগা চোখটা থেঁইতলা গেছে। এরপর থেইকা এক চোখে কিছুই দেখি না। আমার বউটাও মইরা গেছে অসুখে, কামাই করতে পারি না কইয়া পোলাপানগুলা আমারে ফালাইয়া যে যার মতো গেল গা। কী করমু, বিয়া করলাম খুকিরে। খুকি সারাদিন ভিক্ষা কইরা যা পায়, তাই খাইয়া থাকি দু’জন। কয়দিন ধইরা ঘরে খাওন নাই, খিদার যন্ত্রণায় পাগল হইয়া যাইতাছি। কেউ আমাগোর কোনো খোঁজ নেয় না। আমরা কি মানুষ না? আমরা ফকির বইলা আমাগো খোঁজ কেউ নিব না!’

রণেশের স্ত্রী খুকি মারাক বলেন, ‘গরিবের মেয়া আমি, বাপে বিয়া দিছে তার লগে। সংসারে আইয়া দেহি অভাব আর অভাব। কী করমু, জামাই কাজকাম করতে পারে না, আমারে কেউ কামেও নেয় না। পেটে আসলো সন্তান। পোঁটলা লইয়া গেরামে গেরামে ভিক্ষা শুরু করলাম। হেই থেইকা আমি গেরামে খুকি ফকির। দেশে আইছে নাকি কীসের রোগ, এক মাস ধইরা ভিক্ষায় বাইর হইলে কেউ ভিক্ষা দেয় না। সবাই কয়, বাড়ি থেইক্যা বাইর হও।’

মধুপুর উপজেলার জয়নশাহী আদিবাসী পরিষদ গজারিচালা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি লিও চিচামসহ স্থানীয় গজারিচালা গ্রামের প্রণতি মারাক, ছন্দা মারাক, নিলিপ মারাক, বিনেশ রেমা বলেন, কী আর বলব, আমাদের গ্রামের প্রায় ৬০০ মানুষ কর্মহীন হয়ে একেবারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ মানুষগুলো কাজ করলে খেতে পারে, না করলে না খেয়ে থাকে। ফুলবাড়িয়ায় শুনেছি কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হচ্ছে, মধুপুরের কিছু এলাকায়ও ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। অথচ আমাদের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ।

সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অসহায় হতদরিদ্রদের মাঝে প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অনেক আদিবাসী পরিবার- এমন অভিযোগ তাদের। প্রায় এক মাস ধরে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

হাতিলেইট গ্রামের গারো পাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ, ১১০ বছর বয়সের দরথি সাংমা বলেন, ‘জন্মের পর থেইকাই শুনতাছি আমরা আদিবাছি। কেরে ভাই, আমাগো জন্ম এই দেছে না? আমাগোর জায়গাজমি নাই, সরকারের জায়গায় নাকি আমরা থাকি, সরকার কতবার যে উচ্ছেদ করতে চাইল, মারামারি হইলো। সব জায়গা নিয়া গেছেগা, মাইনষের জমিনে কাম কইরা বেবাকে চলে, অহন দেছে দেছে অসুখ, কেউ কামে নেয় না। ঘরের সবাই বেকার। হুনতাছি কত কত জায়গায় সরকার সাহায্য দেয়, আমগোরে দেয় না ক্যান? বিপদের সময় নিজেগোর সংগঠনও কাছে আসে না।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী সুষমা বলেন, আমরা প্রথম ধাপে বর্মণদের নামের তালিকা করে তালিকাভুক্তদের ১০০ জনের মাঝে সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, যার মধ্যে ৫৯ বর্মণ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছি। কিছু আদিবাসী পরিবারকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে আমি নিজে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের নামের তালিকা করছি এবং তাদের ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলার শুধু রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন নয়, উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের দুলমা গ্রামে আদিবাসী গারো পরিবার রয়েছে প্রায় ৮০টি। অন্যের জমিতে কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তারা সবাই বেকার। এ নিয়ে আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘সরকারি অনুদান না পেলে কিছুই করতে পারব না আমরা।’

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল সিদ্দিক ইতোমধ্যে ফুলবাড়িয়া গারো সম্প্রদায় এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে, শিগগির আদিবাসী গারোদের মাঝে বিতরণ করা হব।

Sponsored
Leave a Comment
শেয়ার
সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored