রাশিয়ার তাস মিডিয়ার তথ্যমতে, রাশিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ এণ্ড ট্রেড বিভাগের মন্ত্রী ডেনিস মানতুরভ (Denis Manturov) জানিয়েছেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনী গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নতুন প্রজন্মের আরমাটা টি-১৪ মেইন ব্যাটল ট্যাংকের বেশ কিছু সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। আর আরমাটা টি-১৪ মেইন ব্যাটল ট্যাংকের পারফরমেন্সে বেশ সন্তষ্ট বলে জানিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। তাছাড়া রাশিয়া ইতোমধ্যেই তার পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ জেট ফাইটার এসইউ-৫৭, কমব্যাট ড্রোন অরিয়ন-ই (ইউএভি) ও সাবমেরিন ভিত্তিক ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইলসহ প্রায় দুই শতাধিকের বেশি নতুন নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জামের ব্যাপক পরীক্ষা নীরিক্ষা চালিয়েছে গৃহযুদ্ধ কবলিত সিরিয়ার মাটিতে।
এমনকী পরীক্ষার জন্য সরাসরি নিরীহ মানব বসতির উপর নির্বিচারে অস্ত্র প্রয়োগ করতে কোন রকম দ্বিধা করছে না রাশিয়া এবং এতে করে নিশ্চিতভাবেই হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেও তা কোন ভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মোট কথা গৃহযুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে সামরিক সহায়তার নামে সিরিয়ার মাটিকে অত্যন্ত কৌশলে নতুন নতুন অস্ত্র পরীক্ষার অন্যতম ক্ষেত্র এবং উন্নত বিশ্বকে তাদের সামরিক শক্তিমত্তা দেখনোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে দেশটি। তাছাড়া ধনী দেশগুলোকে রাশিয়া তার নতুন নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র প্রদর্শন এবং খুব সম্ভবত নিজ দেশের প্রথম সারির মিডিয়াকে ব্যবহার করে হলেও সামরিক সাজ সরঞ্জামের গুনগত মান ফলাও করে প্রচার করে অস্ত্র বানিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির কৌশল নিয়ে কাজ করছে পুতিন প্রশাসন। তাছাড়া সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে সরাসরি সিরিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও রাশিয়ার মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সামনে তার অস্ত্র ও প্রযুক্তির গুণগত মান প্রকাশ করা এবং যতটা সম্ভব বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্য নিজ দখলে আনার বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
আর সিরিয়ায় অস্ত্র পরীক্ষা এবং প্রচারের এই হীন কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই। আসলে মার্কিন অস্ত্র উৎপাদনকারী কর্পোরেশন এবং সামরিক সংস্থাগুলো সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রকে অস্ত্র পরীক্ষার এক বাফার জোন হিসেবে ব্যবহার করছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আসাদ সরকারকে উৎখাতের অংশ হিসেবে শতাধিকবার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী এবং পাশাপাশি তারাও কমপক্ষে ১৫০ এর কাছাকাছি নতুন আবিস্কৃত সামরিক সাজ সরঞ্জাম এবং যুদ্ধাস্ত্র সরাসরি সিরয়ায় চলমান সক্রিয় কোন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বসে আছে। আর বিশ্বের প্রথম সারির এসব সুপার পাওয়ার দেশগুলোর অস্ত্র পরীক্ষায় হাজার হাজার সাধারণ সিরীয় জনগণ মৃত্যুবরণ করলেও এরা কিন্তু খুবই আনন্দিত এবং উজ্জেবিত তাদের এসব প্রাণঘাতী অস্ত্রের পরীক্ষার সফলতা ও কার্যকারিতা নিয়ে। আর অস্ত্র বানিজ্য বিঘ্নিত হতে পারে এমন প্রবল আশাঙ্খায় হয়ত সুপার পাওয়ার দেশগুলো চায় না যে মধ্যপ্রাচ্যে অতি শীঘ্রই অশুভ এসব কল্পিত যুদ্ধ বন্ধ হোক।
তবে অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, ১১ই মার্চ ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার প্রাণঘাতী গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ বা তার বেশি সংখ্যক নিরীহ ও সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আরও ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ গৃহহীন হয়ে আন্যদেশে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন কিংবা নিজ দেশের মাটিতেই আসাদ বাহিনী এবং রাশিয়ার বিমান হামলার ভয়ে সপরিবারে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর যাদের অধিকাংশই কিন্তু নারী, প্রবীন ও শিশু। অথচ যুদ্ধের সাথে যাদের আদৌ কোন রকম সম্পর্ক নেই তাদের একটি বড় অংশ জানেই না সিরিয়ায় কেন যুদ্ধ চলছে। তাছাড়া এখনো পর্যন্ত বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি তাদের নিজেদের মতো করে মধ্যপ্রাচ্যে কেউ আসাদ দমনের নামে আবার কেউ বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠি দমনের নামে ব্যাপক হামলা ও গোটা দেশ জুড়ে ধ্বংসলীলা চালালেও যুদ্ধ বন্ধ বা চুড়ান্ত শান্তির কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং অনেকটা সাজানো এই সিরীয় গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক লোক নিহত, আহত কিম্বা নির্যাতিত বা গৃহহীন হয়ে পড়লেও আমার মনে হয় বিশ্বের দুই বৃহৎ সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়াসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশের তেমন কিছু যায় আসে না বা তারা এতে বিন্দুমাত্র দুঃখিত কিংবা অনুশচিত বলে মনে হয় না। তারা কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে যে কোন মূল্যে নিজস্ব কৌশলগত প্রভাব বিস্তার ও অতি লাভজনক অস্ত্র বানিজ্য ও রপ্তানি এবং তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে এক ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
আবার হতাশার সাথে লক্ষ্য করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা ও সক্ষমতা যাচাইয়ের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে চার দশক ব্যাপী অত্যন্ত কৌশলে কোন না কোন ভাবেই বারবার মুসলিম দেশগুলোকে যেমন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া কিংবা অন্য কোন দেশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করছে। যা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিহত করার কেউ আছে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ইরান, তুরস্ক এবং সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতে উঠে রাশিয়ান কিংবা মার্কিনীদের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান এই অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে এবং আগুনে ঘী ঢালার মতো একটি বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে বলেই প্রতিয়মান হয়। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষায় ওআইসি, আরব লীগ ইত্যাদি নামে বেশ কিছু পিকনিক পার্টি মার্কা সংঘ গড়ে উঠলেও তা আজ অবধি মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষায় এবং যুদ্ধের কবল থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠিকে বাঁচাতে মৌখিক তীব্র প্রতিবাদ ও মিটিং ছাড়া আর কিছু করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয় না।