যেসব পুরনো জাহাজের মেয়াদ শেষ হয় সেসব জাহাজ ভেঙ্গে তার রড, ইস্পাত আবার পুনরায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জাহাজ ভাঙ্গা অতি ঝুঁকিপূর্ন কাজ। কারণ পুরনো জাহাজে নানা রকম বিষাক্ত উপাদান থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। তাই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে উন্নত দেশগুলো অধিকতর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ ভেঙ্গে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রযুক্তি থেকে আগে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে তারাও অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ ভাঙ্গতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিতায় বাংলাদেশ সরকার এবং নরওয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
গত ২৪ই জুলাই ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), নরওয়ে এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে পরিবেশগত নিরাপদভাবে জাহাজ ভাঙ্গা প্রকল্পের তৃতীয়বারের মতো আরো একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে অধিকতর উন্নত করতে নরওয়ে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
উল্লেখ্য সেন্সরেক (SENSREC) প্রকল্পের চুক্তিটি প্রথম ধাপে ২০১৫-১৭ সালে এবং দ্বিতীয় ধাপে ২০১৮-২০ সালে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, উভয় ধাপে নরওয়ে অর্থায়ন করে সহযোগিতা করেছে। অতিরিক্ত অর্থায়নের সাথে, প্রকল্পের তৃতীয় ধাপটি ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৮ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
এই চুক্তি অনুযায়ী হংকং কনভেনশন মেনে চলার মাধ্যমে বাংলাদেশের জাহাজের পুনর্ব্যবহারের মান উন্নতকরণ এবং সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করা হবে। পাশাপাশি বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ এবং নিষ্পত্তি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হবে।
বাংলাদেশে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন বলেছিলেন যে, সরকারী কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশের পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের প্রতিশ্রুতি ও কৃতিত্বের জন্য আমাদের সেন্সরেক প্রকল্প ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
তিনি আরো বলেছেন, “বাংলাদেশকে সহায়তা জানাতে পেরে আমরা খুশি এবং আমরা এই প্রকল্পে আইএমও-কে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আইএমওর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের জাহাজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্প এবং দেশের অর্থনীতি বিকাশের প্রচেষ্টা জোরদার করতে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখব।”
এই চুক্তিটি নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মিসেস ব্লেকেন এবং আইএমও সেক্রেটারি-জেনারেল কিটাক লিম স্বাক্ষর করেছেন।
নরওয়ে সরকারকে তাদের উদার অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে মিঃ লিম বলেন, “এই প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় নিরাপদ ও পরিবেশগতভাবে জাহাজ পুনর্ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করবে।”
উল্লেখ্য বৈশ্বিক অর্থনীতির বাজারে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের প্রভাব খুবই মজবুত। বর্তমানে বৈশ্বিকবাজারে ৪০ হাজার কোটি ডলারের বাজার উন্মুক্ত রয়েছে। এই বাজার ধরতে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই শিল্পের দিকে মনোযোগী হচ্ছে দিন দিন। ভারতের সাথে তাল মিলিয়ে এই শিল্পকে বাংলাদেশ এগিয়ে নিয়ে এসেছে বহুদুর। বর্তমানে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের নেতা আমরাই। বেলজিয়ামের ‘দা এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম’ ফেব্রুয়ারিতে এক প্রতিবেদনের তালিকায় দ্বিতীয় বারের মতো শীর্ষস্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক জাহাজ ভাঙ্গা হয়েছে বাংলাদেশে। সে বছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশে ২৩৬টি জাহাজ ভাঙ্গার জন্য আমদানি করে, যা ২০১৮ এর তুলনায় ২০.৪১ শতাংশ বেশি। এর আগেও ২০০৪-২০০৯ এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙ্গাতে বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল। বিশ্বে এই শিল্পে আমাদের প্রতিদন্ধী ভারত, পাকিস্তান, চীন ও তুর্কি। বিশ্বের ৮০% জাহাজ ভাঙ্গা হয় এই এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে।
চট্টগ্রামের উপকূল ধরে প্রায় ১২০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। যার ফলে তৈরি হয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং প্রায় ৫০,০০০ মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত। অন্যদিকে এ শিল্পের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১,০০,০০০ মানুষ। এই বিশাল শ্রমজীবী মানুষগুলোর অধিকাংশই এসেছে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল থেকে। আমাদের দেশের স্থানীয় রড এবং ইস্পাতের বাজার সর্ম্পূণভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। দেশের ইস্পাতের চাহিদার ৬০% আসে এই শিল্প থেকে। তাছারা জাহাজ এবং জাহাজের ভেতরের প্রায় সবই পুনর্ব্যবহারযোগ্য।