এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দাম বেড়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৭০ টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের দাম। ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৫০-৫৫ এবং দেশী ৪০-৪৫ টাকার পেঁয়াজ মানভেদে ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অস্বস্তি বিরাজ করছে পেঁয়াজের বাজারে।
অবস্থায় মসলা জাতীয় এই পণ্যটির দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দাম নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের আমদানির ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ শুল্কহার প্রত্যাহার করা হচ্ছে। টিসিবি খোলা ট্রাকে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এছাড়া অবৈধভাবে মজুদ বা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করা হলে দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের মুখে সোমবার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দোকান বন্ধ রাখে আড়তদাররা।
দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির সভায় দ্রুত পেঁয়াজের দাম সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন। এছাড়া সভায় উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মোঃ ওবায়দুল আজম, অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) মোঃ হাফিজুর রহমান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা, সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আরিফুল হাসানসহ টাস্কফোর্স কমিটির অন্য সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্ক ফোর্স কমিটির বৈঠকে দেশের চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় পর্যালোচনা করা হয়।
এ ছাড়া পেঁয়াজের মজুত, আমদানি ও সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। সভায় জানানো হয় দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে, আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে।
পেঁয়াজের সঙ্কট বা মূল্য বৃদ্ধির কোন সঙ্গত কারণ নেই। পেঁয়াজের অবৈধ মজুত বা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করা হলে সরকার আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা হয়েছে। পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অবিলম্বে খোলা বাজারে ট্রাক সেলের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রয় শুরু করবে।
নতুন পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে টিসিবি। এছাড়া, পেঁয়াজ আমদানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুল্কহার পুনর্নির্ধারনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং আইপি ও কোয়ারেন্টাইন বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
চলতি বাজেটে আমদানিতে কিছুটা শুল্ক আরোপ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, দেশে বর্তমানে প্রচুর পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে।
কিন্তু আমদানিকৃত পেঁয়াজে শূন্য শুল্কহার বিদ্যমান থাকায় দেশীয় পেঁয়াজ চাষীরা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এতে ভবিষ্যতে পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে চাষীরা নিরুৎসাহিত হতে পারে। তাই দেশীয় পেঁয়াজ চাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রপ্তি নিশ্চিতকরণ, পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ প্রদান এবং আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের লক্ষ্যে পেঁয়াজ আমদানিতে কিছুটা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজের ওপর শুল্কহার ধার্য্য হলেও স্থানীয় পর্যায়ে এই পণ্যের সরবরাহের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া গত বছর জুড়ে পেঁয়াজের বাজার অস্থির ছিল।
৩০ টাকার পেঁয়াজ ভোক্তাদের ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্গো বিমানে করে তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আনে সরকার।
আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে নতুন পেঁয়াজ দেশে আমদানি করা হয়। কিন্তু এ বছর সেখানে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে পেঁয়াজের আবাদ মার খেয়েছে। কমেছে উৎপাদন।
ফলে ব্যাঙ্গালুরুর সেই নতুন পেঁয়াজটা এবার আসবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত এ কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এছাড়া দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদেরও কারসাজি রয়েছে।
ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে নজরদারি বাড়িয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অযৌক্তিকভাবে মূল্য বৃদ্ধি করায় কয়েকটি আড়তকে জরিমানাও করা হয়েছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় সোমবার দোকান বন্ধ রাখে আড়তদাররা।
এতে করে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ভোক্তা সাধারণের। সোমবার সকাল থেকেই বন্ধ থাকে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার আড়তগুলো। ব্যবসায়ীরা বিক্রি বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, খাতুনগঞ্জের সড়কে ট্রলি, ভ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন এলোপাতাড়িভাবে রেখে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্য নির্ধারণ খাতুনগঞ্জের আড়তদারদের বিষয় নয়। কারণ এখানে আমদানিকারক নেই। স্থলবন্দর দিয়ে আসা পেঁয়াজ বেপারিরা পাঠিয়ে দেন এবং একইসঙ্গে দামও বেঁধে দেয়া হয় পেঁয়াজের। খুব সামান্য কমিশনে তারা পাইকারিতে পেঁয়াজ বিক্রি করে থাকেন।
জেলা প্রশাসনে ভ্রাম্যমাণ আদালত রবিবার খাতুনগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে। মূলত পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির আলামত দেখতে পেয়ে এ অভিযান চালায় প্রশাসন। অভিযানে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি নেতারা বলছেন, কোন ধরনের কর্মসূচী প্রদান করা হয়নি। আড়তদাররা আতঙ্কিত হয়ে দোকান বন্ধ রেখেছেন। তারা আরও বলেন, খাতুনগঞ্জ বা আড়তগুলোতে অভিযান না চালিয়ে স্থলবন্দরগুলোতে মনিটরিং প্রয়োজন। কারণ আমদানিকারকদের বেঁধে দেয়া দরেই তাদের বিক্রি করতে হয়।
পেঁয়াজের দাম আমদানি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই না করে এ ধরনের অভিযান এক ধরনের অবিচার। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং আলোচনা চলছে। আতঙ্ক কেটে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে তাদের অভিমত।
এদিকে, সোমবার খাতুনগঞ্জে সকাল থেকেই এক ধরনের ধর্মঘটের মতো পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। আড়ত বন্ধ থাকায় বিক্রি হয়নি। ছোট ছোট অযান্ত্রিক বাহনগুলো এলোপাতাড়ি ফেলে রাখায় সড়কেও এক ধরনের অবরোধ অবস্থা।
এদিন স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। পাইকারিতে বিক্রি বন্ধ থাকায় খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।