বিএসএফ-বিজিবি প্রকাশ্য রেষারেষি কি কোনো বি ইঙ্গিত?

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান বহু পুরনো পরিচিত ঘটনা। কিন্তু এ মাসে এই বিষয় নিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যেভাবে প্রকাশ্যে, বিবৃতি দিয়ে পরস্পরকে এই চোরাচালানের অংশীদার বলে দায়ী করছে, তার নজির বিরল।

পাচার করা গরু দিয়ে কোরবানি হয় কিনা, সে ধরণের কোরবানি পশু নির্যাতনের সামিল কিনা – বিবৃতি দিয়ে বিএসএফের মত একটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে সেই প্রশ্ন তোলার নজিরবিহীন ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে বিস্ময় তৈরি হয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার

এনিয়ে বাংলাদেশের সীমাতরক্ষা বাহিনী ক্ন্বিজিবির সাবেক প্রধান লে.জে. (অব) মইনুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে এক বাহিনী আরেকটি বাহিনীকে চোরাচালানে জড়িত থাকার জন্য দায়ী করার এই ঘটনায় তিনি বিস্মিত।

বিএসএফ কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করেনি, প্রতিবেশী দেশের একটি পুরো বাহিনীকে দায়ী করেছে। এটা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি অন্যায়। ফলে বিজিবির পক্ষ থেকে পাল্টা বিবৃতি জারী করা যথাযথ হয়েছে বলে আমি মনে করি।

ঝগড়ার শুরু যেভাবে

সীমান্তের দুই পারের বিরোধের মূল কেন্দ্রে রয়েছে গরু। এই ঝগড়ার শুরু ৬ই জুলাই যখন বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি এসএস গুলেরিয়া ঈদের আগে গরু চোরাচালান নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেন।

বিএসএফের ঐ বিবৃতিতে বিজিবিকে এই চোরাচালানে মদত দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

একইসাথে ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, যেভাবে কোরবানির উদ্দেশ্যে গরুগুলোকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকানো হয় তা পশু নির্যাতনের সামিল, এবং ঐ গরু দিয়ে আদৌ কোরবানি হয় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

বিএসএফের ঐ বিবৃতির দুই সপ্তাহ পর গত রোববার বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পক্ষ থেকে একটি পাল্টা বিবৃতি জারি করে চোরাচালানের পেছনে বিএসএফের মদতের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় চোরাকারবারিদের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় ভারতের মাটিতে গরু সমাগম ও নদীপথে গরু পাচারে বিএসএফের নিস্ক্রিয়তা নি:সন্দেহে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করে।

কোরবানির সাথে পশু নির্যাতন নিয়ে যে প্রশ্ন বিএসএফ তুলেছে, তার তীব্র প্রতিবাদ করে বিজিবি বলেছে, এই ধরণের বক্তব্য ঈদুল আজহার জন্য অবমাননাকর এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হানার সামিল।

চাপ তৈরির চেষ্টা?

লে.জে (অব) মইনুল ইসলাম মনে করেন, গরু চোরাচালান নিয়ে ৬ই জুলাই প্রকাশিত বিএসএফের ঐ অস্বাভাবিক বিবৃতি এককভাবে ঐ বাহিনী দিতে পারেনা এবং এর পেছনে ভারত সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কাজ করেছে।

সীমান্তে নানারকম মতবিরোধ রুটিন ব্যাপারে। স্থানীয়ভাবে তার সমাধান হয়। গুরুতর মতবিরোধ দেখা দিলে কূটনৈতিক পর্যায়ে তার সমাধানের চেষ্টা হয়, কিন্তু এখানে তা হয়নি…বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে কথা বলা একেবারেই অবিবেচকের কাজ হয়েছে।

আমি বুঝতে পারছি না কেন ভারত সরকার একটি বর্ডার ফোর্সকে দিয়ে এমন সব কথা বলাতে গেল!

জেনারেল ইসলাম সন্দেহ করছেন, চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চুপ থাকার জন্য বাংলাদেশের ওপর ভারত হয়তো কোনো চাপ তৈরির চেষ্টা করছে।

চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাত নিয়ে ভারতের প্রতিবেশীরা কেউ কোনো কথা বলেনি। ভারত হয়ত এটা ভালোভাবে নেয়নি…এটা হতে পারে চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।

এটা অনস্বীকার্য যে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কাশ্মীরে পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে যেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সহমর্মীতা জানিয়ে বিবৃতি জারি করা হয়েছিল, সেখানে গালওয়ানে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যর মৃত্যু নিয়ে চুপ ছিল ঢাকা।

পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, ভারত সরকার এবং ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির একটি অংশের মধ্যে প্রতিবেশীদের এই ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

মার্কিন সাময়িকী ব্লুমবার্গে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে অর্চনা চৌধুরী এবং বিভুদত্ত ওরাধান লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী যদি আশা করে থাকেন বিপদের সময় তিনি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমর্থন পাবেন, তিনি ভুল ভেবেছিলেন। যেখানে তাদের সৈন্যের নিহত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন সমবেদনা জানিয়েছে, ট্র্যাডিশনাল মিত্র বাংলাদেশ এবং নেপাল সেখানে ছিল নিশ্চুপ।

ঐ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফার শাসনে তার কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডায় প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়, সন্দেহ অস্বস্তি ঢুকেছে।

এটা সবারই জানা যে, ভারতে এনআরসি এবং ধর্মের ভিত্তিতে করা সংশোধনী নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশ একেবারেই খুশি নয়।

‘ভারত বাংলাদেশকে হারাতে চায়না‘

তবে দিল্লির জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীন-ভারত বিরোধে পক্ষ নেওয়ার জন্য ভারত বাংলাদেশের ওপর বড় কোনো চাপ তৈরি করবে বলে তিনি মনে করেন না।

আমি বিশ্বাস করি, গরু চোলাচালান নিয়ে বিএসএফের বিবৃতির সাথে ভারত সরকারের বৃহত্তর নীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গরু চোরাচালান কমাতে তারা প্রকাশ্যে কথা বলছে … গরু চোরাচালান অনেকের কাছে আর দশটি ব্যবসার মত একটি ব্যবসা, কিন্তু অনেকের কাছে গরু এটি একটি ধর্ম বিশ্বাস।

তিনি বলেন, আঞ্চলিক বড় দুই শক্তির বিরোধে ছোটো দেশগুলো যে চুপ থাকবে – এই বাস্তবতা ভারতের নীতি-নির্ধারকরা বোঝেন।

চীন-ভারত বিরোধ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছোটো দেশগুলো ভেতরে ভেতরে হয়তো খুশি। তারা মনে করছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একাধিপত্যকে চীন চ্যালেঞ্জ করছে, এবং তারা মনে করছে ভারতের সাথে সম্পর্কে একটা ভারসাম্য তৈরি করার ক্ষেত্রে এটা তাদের একটি সুযোগ।

শীতল যুদ্ধের সময় এটা দেখা গেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি মনস্তত্ব, এবং আমার মনে হয় ভারতের নীতি-নির্ধারকরা তা বোঝেন।

অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, চীন পরোক্ষাভাবে সেই ভারসাম্য তৈরিতে সাহায্য করছে।

তিনি মনে করেন, ভারত যদি বাংলাদেশের মত দেশের কাছ থেকে এসময় আনুগত্য প্রত্যাশাও করে, তার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরির ঝুঁকি নেবেনা।

বাংলাদেশকে হারানোর কোনো ঝুঁকি ভারত এখন নেবেনা।

আর তাছাড়া, চীনের সাথে ‘বাফার স্টেট’ হিসাবে নেপাল বা ভুটানকে নিয়ে ভারতের যে উদ্বেগ, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ততটা নেই।

উপরন্তু, অধ্যাপক ভরদোয়াজের মতে, ভারত এখনও চীনের সাথে পুরাদস্তুর বিরোধে জড়াতে অনিচ্ছুক, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এখনও চীনকে একটি সুযোগ হিসাবে দেখে ভারত।

নিরাপত্তার উদ্বেগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক চাইছে ভারত, কিন্তু ভারত এখনও যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্লায়েন্ট স্টেট হতে অনিচ্ছুক। এবং সেজন্য ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে পুরোপুরি ঢোকার ব্যাপারে ভারতের মধ্যে এখনও কুণ্ঠা রয়েছে।

ভারসাম্য তৈরি করছে চীন

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তৈরি চীন-বিরোধী জোটগুলোতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে ঢুকে পড়তে বাধ্য হবে। আর সেইসাথে বদলে যাবে তাদের বৈদেশিক এবং কৌশলগত সম্পর্কের নীতি।

বাংলাদেশের মত দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের পক্ষে তখন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দিনদিন দুরূহ হয়ে পড়তে পারে।

অবশ্য হংকংয়ের দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে এক সাক্ষাৎকারে চীনা সাবেক কূটনীতিক এবং বেইজিংয়ে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝাং জিয়াডং বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একাধিপত্যের ভয়ে ছোটো দেশগুলোর চীনের দিকে ঝুঁকছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের একটি শিবিরেই থাকতে হবে।

যতক্ষণ পর্যন্ত চীন ও ভারতের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য রয়েছে ততক্ষণ ছোটো দেশগুলোর স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়ার সুযোগ থাকবে। জবরদস্তি করে কোনো একটি পক্ষে তাদের নেওয়া যাবেনা।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored