সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক শ মানুষ।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক ব্যক্তির ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে তাঁর কয়েক শ অনুসারী গতকাল বুধবার সকালে ওই গ্রামে হামলা চালায়।
এ সময় হামলাকারীরা অন্তত ৮৮টি বাড়িঘর এবং সাত-আটটি পারিবারিক মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া ঝুমন দাস আপনের ঘরের বিছানা ছিল এলোমেলো। মেঝেতে পড়ে আছে রান্নার সরঞ্জাম। ঘরে কেউ নেই।
পাশের ঘরের লোকজন জানায়, হামলার সময় দৌড়ে পালাতে গিয়ে আহত হয়েছেন ঝুমন দাসের স্ত্রী। তিনি চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরে গেছেন। গ্রামবাসী আতঙ্কিত।
পাশে রবীন্দ্র দাসের ঘরসহ কয়েকটি কাঁচা ঘরেও হামলার চিহ্ন দেখা গেছে। ঘরের ভেতরে চেয়ার, স্টিলের আলমারি, শোকেসসহ বিভিন্ন আসবাব ভাঙা।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাস বকুলের ঘরও ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে শাল্লা ও দিরাই থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলাকারীরা লাঠিসোঁটা, দা, রামদা, কিরিচসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দাড়াইন নদী পার হয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল নিয়ে আসতে থাকে।
বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে গ্রামের নারী-পুরুষ ঘরবাড়ি ফেলে বাইরে পালিয়ে যায়। অনেকে ঘর তালাবদ্ধ করে ভেতরে বসে থাকে।
নাচনি গ্রামের স্বাধীন মেম্বার ও ফক্কনের নেতৃত্বে কয়েক শ মানুষ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস, কাজল চন্দ্র দাস, সুনু রঞ্জন দাস, অনিল কান্তি দাসসহ গ্রামের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘরে হামলা করে।
মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্রের পাকা ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে।
এরপর গ্রামের একে একে ৮৮টি ঘরে হামলা ও লুটপাট চালায় তারা। গ্রামের পারিবারিক মন্দির ভাঙচুর করে একটি থেকে কষ্টিপাথরের মূতি নিয়ে যায়। প্রতিটি ঘর থেকেই টাকা, পয়সা, সোনাদানাসহ মূল্যবান জিনিস লুট করে হামলাকারীরা।
গ্রামবাসী জানায়, হামলায় অংশ নেয় নাচনি গ্রামের স্বাধীন মিয়া, ইমারত আলী, ইনাত আলী, মির্জা হোসেন, নেহার আলী, আলম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, আলকাছ, হুমায়ুন, লুত্ফুর, মো. ফারুক, আকরামত, কেরামত, কাশিপুর গ্রামের নবাব মিয়া, সাইফুল, আব্দুল মজিদ, তৌহিদসহ শতাধিক লোক।
ওই গ্রামের শৈলেন দাস বলেন, ঝুমন দাসকে আমরা নিজেরাই ধরে পুলিশে দিয়েছি। আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমার আলমারি ভেঙে সোনাদানা, টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। ঘরের সব কাপড়-চোপড়ও নিয়ে গেছে।
গতকাল দুপুর ১টার দিকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, অপরাধীদের কোনো পরিচয় নেই, তারা শুধুই অপরাধী।
ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যেভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমনি হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রামে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রশাসন আপনাদের পাশে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পারিবারিক পূজার স্থান মেরামত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে জিআরের চাল ও নগদ অর্থ সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
জানা যায়, গত সোমবার দিরাইয়ে হেফাজতের এক সমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক। ওই দিন রাতে নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস আপন তাঁর ফেসবুকে মামুনুল হককে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেন।
বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে এলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে লোকজন। পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্থানীয় দাড়াইন বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ করে তারা। রাতেই উপজেলার শাসকাই গ্রাম থেকে ঝুমনকে আটক করে শাল্লা থানা পুলিশ।
ঝুমনকে আটকের পর রাতভর পাশের দিরাই উপজেলার চণ্ডিপুর, ধনপুর, শ্যামারচরসহ, শাল্লা উপজেলার কাশীপুর, আনন্দপুর, সুলতানপুর গ্রামে দফায় দফায় বৈঠক করে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন শাল্ল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ আল আমিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মুক্তাদিরসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। হেফাজতে ইসলামের দিরাই উপজেলা সহসভাপতি মাওলানা নূর উদ্দিন বলেন, ‘কারা হামলায় জড়িত আমরা জানি না।’
এদিকে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করা হয়নি।