মিশরীয় ফুটবলার মোহাম্মদ সালাহ লিভারপুল ক্লাবে আসেন ২০১৭ এর জুন-জুলাইতে। সেসময়ের রেকর্ড ব্রেকিং প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে ইতালিয়ান ক্লাব রোমা থেকে কিনে আনে কোচ ইয়ুর্গান ক্লপ এবং এটা নিয়ে তখন অনেকে হাসাহাসি হয়- কারণ মো সালাহ এর আগে সালে আরেক ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে এসেছিলেন কিন্তু এক সিজন তেমন সুবিধা করতে না পেরে আবার ইতালিয়ান লীগে চলে যান। সেই “চেলসি রিজেক্ট” কে এত টাকায় কিনে আনাটা অনেকের কাছে বোকার মত টাকা ঢালা মনে হয়।
কিন্তু প্রথম সিজনের পরই দৃশ্যপট চেইঞ্জ! মো সালাহকে ঠিক ভাবে ইউজ করতে পেরেছিলেন ক্লপ এবং তার ফলাফলে প্রথম সিজনে লিভারপুলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ভাংগেন তিনি ও এক সিজনে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড প্রায় ভাংগার কাছাকাছি চলে যান প্রথম সিজনেই! আর এর ফলাফল হয় অসাধারণ!
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা যায়- মো সালাহ লিভারপুলে আসার পর ঐ এলাকায় ইসলামোফোবিয়া ও হেইট ক্রাইম কমে গেছে ২০%!! অথচ এই লিভারপুলের মাঠ এনফিল্ডেই ২ বছর আগে দুই মুসলিম ফ্যান খেলার মাঝে ব্রেকে সিঁড়ির পিছনে নামজ পড়ার সময় সেটার ছবি তুলে অনলাইনে ভাইরাল করা হয় “Disgrace” ট্যাগ দিয়ে!
আর মো সালাহ তার খেলোয়ারি দক্ষতা, নম্রতা ভদ্রতা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে এমনই মুগ্ধ করে ফেলে লিভারপুলের ফ্যানদের যে তারা তার নামে জয়ধ্বনি বানায় এরকম- “”If he’s good enough for you, he’s good enough for me. If he scores another few, then I’ll be Muslim too.” কিংবা “He’s sitting in the mosque, that’s where I want to be.” মানে সালাহ যদি আরো গোল করে, তারা মুসলিম হয়ে যাবে, সালাহ যদি মসজিদে থাকে, তারাও মসজিদে যাবে! লিভারপুল তাদের ক্লাবে প্রথমবারের মত মুসলিমদের নামাজ পড়ার ঘর বসায়!
মো সালাহের ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করে যাওয়াই নয় শুধু- তার এই তুমুল জনপ্রিয়তার পিছনে আছে সর্বদা হাসিমুখ, মিডিয়ার সামনে খুব ডাউন টু দ্যা আর্থ হয়ে থাকা ও অসংখ্য চ্যারিটেবল কাজকর্ম- মো সালাহ প্রমাণ করে দেয় একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম কতটা অসাধরণ আইডল হতে পারেন সবার জন্য! এবং সে তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে মোটেও লুকোছাপা করেনি- প্রতি ম্যাচের আগে তাকে হাত তুলে দুয়া করতে দেখা যায়, গোলের পর সেজদা দিয়ে তার সেলিব্রেশন করা তো ফিফা-১৯ গেমেই এড করা হয়েছে! এমনকি অনেক লিভারপুল অমুসলিম ফ্যানদের মো সালাহকে ট্রিবিউট করা সেজদার ছবিও ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
মো সালাহের সবচেয়ে বড় গুন হলো সে কখনও নিজের মূলকে ভুলে যায়নি- মিশরের Nagrig নামের যে ছোট গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে উঠা সেখানে সে প্রচুর সাহায্য করে। প্রায় ৪৫০ টি পরিবারকে সে চালায় এবং সরাসরি সরকারকে ৩ লাখ ডলার সাহায্য করেছিলো। একবার তার বাবার বাসায় এক চোর ধরা পড়ার পর তার বাবা পুলিশে দিতে গেলে উলটো সালাহ তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে এবং চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। এসব ব্যাপার সাথে টানা তিন সিজন লিভারপুলের হয়ে অসাধারণ পারফর্ম্যান্স ও মিশরকে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে তোলায় মিশরে তার জনপ্রিয়তা বর্ণনাতীত! মিশরের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ব্যলট কাগজে প্রার্থীদের নাম কেটে তার নাম লিখে পাশে সিল মেরে এসেছিলো!
লিভারপুলের মুসলিম কমিউনিটি সালাহের কারণে কতটা উপকৃত হয়েছে- সেটা আসলে তাদের মুখে না শুনলে বুঝা যাবে না। লিভারপুলের স্থানীয়রা যখন দেখে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ওয়ার্ল্ড ক্লাস ফুটবলার হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করেও, প্রচুর খ্যাতি ও অর্থের মধ্যে থেকেও কোন রকম খারাপ কারণে খবরে আসে না, মদ খায়না, বিশৃঙ্খলতা করে না, দারুন ফ্যামিলি পার্সন, ফ্যানদের সাথে খুবই মিশুক, প্রাউডলি মাঠে ও মাঠের বাইরে নিজের ধর্মীয় পরিচয় শো-অফ করে তখন মিডিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত যে মুসলিমদের একটা নেগেটিভ ভাবমূর্তি তৈরী করার চেষ্টা করা হয় তাতে ভালই আঘাত লাগে! শুধু ভাবমূর্তি উন্নয়ন বা বিধর্মীদের কাছে মুসলিমদের গ্রহণযোগতা বৃদ্ধিই নয়, মো সালাহের প্রতি মুগ্ধতা থেকে লিভারপুল ফ্যানদের ইসলাম ধর্মে কনাভার্টেড হওয়ার ঘটনাও ঘটছে!
নিজের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, অন্যদের নিজের ধর্মের প্রতি আকর্ষিত করতে প্রথমত নিজে ঐ বিশ্বাসের উপর পূর্ণ আস্থা আনতে হয়- নিজেকে সর্বোত্তম একটা আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। মোহাম্মদ সালাহ তার অসাধারণ একজন উদাহরণ। নিজে ভোগ বিলাশে মত্ত হয়ে, বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করে সুধু মুখে ইসলামের গুনগান করলে না সে নিজের ধর্মে গ্রহণযোগ্যতা পেত না তার কারণে একটা রেইসিস্ট, ইসলামোফোব এলাকায় মুসলিমদের ভাবমূর্তি বাড়তো।
কথায় নয়- কাজে বাকিদের চেয়ে বেটার প্রমাণ করতে হবে। হিংসা বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়িয়ে নিজে কিছুটা মেনে কিছুটা না মেনে আর যাইহোক অন্যকে নিজের আইডিওলজির প্রতি টানা যায়না বরং মানুষকে আরো দুরেই ঠেলা হয়! লিভারপুলের হয়ে ৩০ বছর পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ জেতায় মোহাম্মদ সালাহকে অভিনন্দন। সে তার এই বিশ্বাসে, অনুসরনীয় লাইফস্টাইলে অটুট থাকলে তার সামনে আরো অনেক সাফল্য অপেক্ষা করছে- এটা আশা করাই যায়!