সবাই যে নিজের পছন্দেই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন, তা তো নয়! নানা কারণে একা হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। করোনা বিধ্বস্ত সময় এই মানুষগুলির বিপন্নতাকে নতুনভাবে চিনতে শিখাচ্ছে আমাদের। এমনিতে স্বাভাবিক সময়ে আমরা এদের প্রতি একেবারেই মনোযোগী নয় বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না। ক’দিন আগে আমাদের পাড়া যখন ঘোষিত নিষ্প্রদীপে ডুবে গেল, আমার বাড়ির সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধা। তাঁকে দেখে কবিতাটা মনে পড়ে গেল আমার। মোবাইল হাতে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক যেন আঁধার রাতে কুয়াশায় ঘেরা একটা বাতিঘর। সে ডাক পাঠাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে চলে যাওয়া একের পর এক জাহাজকে। তারা কিন্তু কেউই তাঁর ডাক শুনতে নারাজ।
লকডাউন শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে এই মানুষগুলির জীবনে। ঘটে গেছে একের পর এক শাটডাউন। মুখ ফিরিয়েছেন আত্মীয়স্বজন। এমনকী ছেলেমেয়েরাও। উনাদের অনেকে আগে চাকরি করতেন, কারও বা রয়েছে কিছু বিষয়সম্পত্তি। তাই আর্থিকভাবে অন্যের উপর ততটা নির্ভরশীল নন। কিন্তু অর্থ আর কবে নিঃসঙ্গতার সমস্যাকে মোকাবিলা করতে পেরেছে? তাই দিন কাটে, বিচ্ছিন্নতা কাটে না। দেখেছি একা থাকা লোকেদের অন্যের সঙ্গে দেখা করা, সম্পর্ক রাখার ইচ্ছেটাও যেন কোনও এক ম্যাজিকে ভ্যানিশ হয়ে যায়। লোকে তাঁদের মনে করে অহঙ্কারি, বা মোটেই মিশুকে নন। অনেকের সঙ্গে পাড়ার লোকেদের যোগাযোগ শুধুই ঈদে ঈদগাহে নামাজ আদায়ের সময়। পাড়ায় থেকেও তাঁরা যেন সেই সমুদ্রের বাতিঘরের মত একা।
করোনার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭-১৮ সালকে এপিডেমিক অব লোনলিনেস বলে ঘোষণা করা হয়েছিল সমস্যাটার প্রতি মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে। অবস্থা তাতে বদলায়নি। মনোবিদদের সাবধানবাণী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির প্রয়াস, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের আবেদন যা পারেনি, তা পারল করোনা। করোনায় মৃত্যুমিছিল আবার ফিরিয়ে আনলো নিঃসঙ্গ মৃত্যুর স্মৃতি। আমার আমেরিকা প্রবাসী এক বন্ধু ক’দিন আগেই জানাল, তাদের এলাকায় একা থাকা মানুষদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ওর একজন বন্ধু নিঃসঙ্গ মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ দিয়ে আসছে। সে ওকে বলেছে, এদের অবস্থা দেখে আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না, তাই ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মানুষটাকে দেখে আমার বন্ধু সিপনের মনে পড়ে গেছে। এভাবেই মিথের পুনর্নির্মাণ ঘটে।
আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশেও ঘটছে একই ঘটনা। বিশ্বব্যাপী মহামারী স্থান-কাল-পাত্র সব একাকার করে দিয়েছে। করোনা বিধ্বস্ত সময়ে শহরে জেগে উঠেছে মানুষের ভিতরের মানুষ। পাড়ার ছেলেরা নিঃসঙ্গ বা একা থাকা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, কেমন আছেন তাঁরা। সদা গম্ভীর পাড়ার মুদির দোকানের মালিক মাসকাবারি জিনিস পৌঁছে দিয়ে আসছেন তাদের বাড়িতে। একা থাকা খালার অনুরোধ মেনে কাজের মেয়েটি এখন আর রাতে বাড়ি ফিরছে না, খালার বাড়িতেই রাত কাটাচ্ছে সে। করোনা যেন মনুষ্যত্বের পুনর্নির্মাণ ঘটাল।
অনেকে বলবেন এ আর এমন কী? আমাদের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজসেবীরাও তো এর থেকেও কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। নিশ্চয়ই তাই। গুরুত্বপূর্ণ বলেই তো সেসব কাজ প্রচারের আলো পায়। কিন্তু নীরবে করে চলা এসব কাজের একটা অন্যরকম গুরুত্ব আছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে মনে করিয়ে দেওয়ার গুরুত্ব। বাতিল হয়ে যাওয়া একা থাকা মানুষগুলির দিকে চোখ ফেরানোর গুরুত্ব। এসব কাজ সমাজটাকে সমাজ বলে ভাবতে শেখায়। এতে আত্মশুদ্ধি হয়। ‘বেঁধে বেঁধে থাকা’ কথাটার অর্থ নতুনভাবে আবিষ্কার করি আমরা। এই কাজগুলোর মধ্যে দিয়ে মানুষ তার পাশের মানুষটির আর একটা পরিচয়কে চিনতে শেখে। নতুনভাবে চেনে তার পুরনো পাড়াকে। মানুষের যে সামাজিক বা সমষ্টিগত পরিচয়টিকে আমরা স্কুলপাঠ্য রচনার বইতে আটকে রেখেছিলাম, সঙ্কট তাকে যেন সামনে নিয়ে আসে।
দল বেঁধে মিলেমিশে থাকার অভ্যাসটা আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই পেয়েছি। কোনও প্রাণী যে একা থাকে, থাকতে পারে এই বোধটাই ছিল না তাদের। সঙ্ঘবদ্ধ থাকলে যে বেঁচে থাকা সহজ হয়, এই মোদ্দা কথাটা বুঝত তারা। তাই নিঃসঙ্গতার সমস্যা তাদের কখনও গ্রাস করেনি। সিদ্ধিলাভের জন্য দুর্গম জায়গায় গিয়ে একা তপস্যা করা কিংবা কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষের একাকী ঘুরে বেড়ানোর ঘটনাগুলি ঘটেছে আরও পরের আমলে। এমনকী যে মুনিঋষিরা আশ্রমিক জীবনযাপন করতেন, তাঁরাও থাকতেন দল বেঁধে। মানসিক সমস্যা আছে, এমন অনেক মানুষ একা থাকতে চান, কিন্তু সে তো একটা মানসিক ব্যাধি! গভীর আঘাত পাওয়া অনেক মানুষ বেছে নেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। সেটাও তো একটা বিশেষ পরিস্থিতি। এসব মোটেই মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয়। সভ্যতা মানেই যে সঙ্ঘবদ্ধতা, ব্যক্তি পরিসর বজায় রেখে সামাজিক জীবনে থাকা এটা আমরা ভুলতে বসেছিলাম। করোনার মৃত্যুমিছিল আমাদের সেই বিস্মরণ থেকে উদ্ধার করে নিজেদের শক্তিকে আবিষ্কার করতে শেখাল।
আমেরিকা, যেখানে নিঃসঙ্গতার সমস্যা সবচেয়ে বেশি, সেখানে প্রতি চারজন মানুষের একজন একা থাকেন। যেখানে হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে করোনা আক্রান্ত মানুষ মারা যাচ্ছেন, সেখানকার পরিস্থিতিটা একবার চিন্তা করুন। চিন্তা করুন বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ, অশক্ত মানুষগুলির কথা! করোনা এড়াতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বহুদিন ধরে তৈরি হওয়া মানসিক দূরত্বের সমস্যা কাটবে কীভাবে? যেখানে অর্থবল, পরিকাঠামো, পরিষেবা ব্যবস্থার কোন ঘাটতি নেই, সেখানেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নিঃসঙ্গতার সমস্যা অন্য জায়গায় কী বিরাট সমস্যা তৈরি করছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এ ঘটনা শুধু আমেরিকা নয়, ঘটছে গ্লোবাল ভিলেজের নানা প্রান্তে।
এ লড়াই কঠিন লড়াই। এই পরিস্থিতিতে আমরা লড়তে পারি শুধু আমাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে। অনেক মানুষ এবং সংগঠন করোনা পরিস্থিতিতে নিঃসঙ্গ মানুষগুলির পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আমরাও তাঁদের পাশে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী থাকতে পারি। কেউ যদি একা থাকা মানুষদের প্রয়োজনীয় ওষুধ বা কয়েকদিনের বাজার করে দিয়েও আসতে পারি, কিংবা ফোনে তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারি, তাতেও একটা বড় কাজ হয়। লকডাউন এখন প্রবেশ করেছে কোয়ারেন্টাইনে।
বাড়ছে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। বাধ্যতামূলকভাবে অনেকে সমাজ সংসার প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছেন। আবার আক্রান্তদের পরিবারবর্গও বহু জায়গায় পড়ছেন অবুঝ পড়শিদের রোষে। পাড়ায় রোগ এনেছেন বলে এক শ্রেণীর প্রতিবেশী গাল পাড়ছেন তাদের।
করোনা কেটে যাবে, বন্ধ হবে মৃত্যুমিছিল, তালা ঝুলবে কোয়ারেন্টাইনের দরজায়। জীবন আবার ফিরবে তার চেনা ছন্দে। দুঃসময়ে মানুষকে পাশে পাওয়ার অভিজ্ঞতা যদি নিঃসঙ্গ মানুষগুলির জীবনের প্রতি বিশ্বাসকে আবার ফিরিয়ে আনে, তাহলে তা হবে এই দুঃসময়েও এক পরম প্রাপ্তি। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি আমাদের লড়তে হবে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া নিঃসঙ্গতার ভাইরাসের বিরুদ্ধেও। এই সময় নিঃসঙ্গ মানুষদের পাশে আরও বেশি করে থাকার মধ্যে দিয়ে একাজটা করা যেতে পারে। আজ বা কাল করোনার প্রতিষেধক বেরবেই। কিন্তু নিঃসঙ্গতা দূর করার তো কোনও ওষুধ নেই। একমাত্র মানবিক সম্পর্কই নিঃসঙ্গতার মহামারীকে পরাস্ত করতে পারে।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…
সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…
পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…
রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…
Leave a Comment