যখন দেখি, অসুস্থ্যেএকজন মানুষ সারা রাত চেষ্টা করে একজন ডাক্তার পান না, তার স্ত্রী’র শত চেষ্টায়ও কেউ মুখ তুলে একবার বলেন না, কি হয়েছে তখন কান্নায় বুক ফেটে যায়। আমরা কি মানুষ? শুধু তাই নয়, বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যাওয়ার পর কিছু মানুষ তাকে দাফন করতে দিতেও নারাজ। এরা কি মানুষ?
যে চিকিৎসক সমাজ, মানব সেবাকে ব্রত করে ডাক্তার হয়েছেন। মানব সেবার নাম করে সরকারী চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্রাকটিসকে হালাল করে নিয়েছেন, যিনি মাঝ রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন সারা বছর, আজ মানব জাতির সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকালে তাদের প্রয়োজন হলো ছুটি কাটানো। অধিকাংশ প্রাইভেট প্রাকটিস তারা বন্ধ করে দিলেন। যেন করোনা ছাড়া আর কোন অসুখ এ সময় মানুষের হবে না। আপনার হার্ট এটাক হলেও এখন বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে। আর যদি আপনার ঠান্ডা জ্বর বা নিউমেনিয়া হয়, তাহলো তো আপনাকে এলাকা ছাড়া করবে। ডাক্তারকে আপনি ধরতে পারবেন না, সে আপনার জ্বর শুনেই পালাবে।
বিশ্বব্যাপী শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারী করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর মিছিল থামছেনা হু হু করে বেড়ে চলছে মৃতের সংখ্যা। আমাদের দেশেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেই সাথে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এবং ভয়ও বাড়ছে। করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি হওয়ার কারণ, এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়া। প্রত্যেকের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল যে, করোনায় আক্রান্ত হলে আর রক্ষা নেই, মৃত্যু অবধারিত। অথচ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মানলে এ থেকে মুক্ত থাকা যায়। রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াছে হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি কাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আতঙ্ক মানুষকে অমানবিকও করে তুলছে। এমন কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে যা মানবতাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বা সুরক্ষিত থাকতে কারো প্রতি যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, দেশবাসীর প্রতি এই আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহ এক মহিলাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী এ আহবান জানিয়েছেন। গত সোমবার করোনা রোগ সন্দেহে রাতে এই মহিলাকে তার স্বামী ও ছেলেরা সখিপুরের গভীর বনে ফেলে চলে যায়। ওদিকে সুনামগঞ্জে এক বৃদ্ধ মাকে ছেলে ঘর থেকে বের করে দেয়। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে রাজধানীর চারটি হাসপাতল ঘুরেও এক স্ত্রী চিকিৎসা করাতে পারেনি তার স্বামীকে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়। শুধু এসব ঘটনাই নয়, করোনাকে কেন্দ্র করে এমন আরও অনেক অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে।
বিপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, দাঁড়াতে না পারলেও সহমর্মিতা প্রকাশ করবে, এটাই মনুষ্যত্বের পরিচয়। করোনাকে কেন্দ্র করে আমরা অনেককে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ চেতনা নিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি এবং দেখছি। দান গ্রহণ করার চেয়ে দান করার মধ্যে আনন্দ বেশি, এমন তৃপ্তি নিয়ে অনেককে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এসব অসামান্য চিত্রের পাশাপাশি এমন কিছু অমানবিক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, যাতে ব্যথিত না হয়ে পারা যায় না। এসব কর্মকান্ড মনুষ্যত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিপদ যে এক শ্রেণির মানুষকে অমানুষে পরিণত করে, তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা নাহলে সন্তান কেন মাকে রাস্তায় ফেলে যাবে? রোগী নিয়ে গেলে হাসপাতাল কেন ফিরিয়ে দেবে? গরিবের রিজিক ত্রাণ কেন লুটপাট হবে? করোনা চিকিৎসায় যেসব চিকিৎসক, নার্স ও সহায়তাকারী রয়েছে, তাদের অনেককে বাড়িওয়ালারা বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। বাড়িওয়ালারা এটা বিবেচনা করছে না, চিকিৎসকরা নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত। তারা যদি বিপন্নতার শিকার হয়, তাহলে করোনা চিকিৎসা যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি এর প্রকোপ থেকে আমরা কেউই নিরাপদ থাকতে পারব না। বরং এ দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিয়ে মানসিকভাবে চাঙা রাখতে পারলে এ থেকে উত্তরণের পথ সহজ হয়ে যাবে। এ সময়ে চিকিৎসকদের সহায়তা করা মানবিকতার পরিচায়ক। মাসব্যাপী অঘোষিত লকডাউনে পড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠি ও দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। উপার্জনহারা হয়ে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাদের জন্য সরকার যে ত্রাণ বরাদ্দ করেছে তা ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতাকর্মী লোপাট করে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার টন চাল চুরি করার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দুঃখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী যেখানে অত্যন্ত দরদ ও আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে তাঁর দলের কিছু নেতাকর্মী গরিবের হক মেরে দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যদিও এদের অনেকে ধরা পড়েছে এবং কাউকে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, এই জীবন-মরণকালে তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মানবিকতাবোধ কাজ করল না কেন? যেখানে তাদের নিজ উদ্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা, উল্টো তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার লুটপাট করা চরম অমানবিকতা ছাড়া আর কি হতে পারে?
কিছু মানুষের অমানবিক আচরণ মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষকে যারপরনাই ব্যথিত করেছে। আমাদের চিরায়ত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে এ ধরনের অমানবিক ঘটনা যায় না। এসব ঘটনা অস্বাভাবিক এবং তা আমাদেরই সংশোধন করতে হবে। মানুষের মধ্যে মানবিক চেতনা শানিত করতে সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আমাদের যে চিরন্তন বৈশিষ্ট্য তা মানুষের মাঝে বেশি করে তুলে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কিছু মানুষের অমানবিক আচরণের বিষয়টি আমলে নিয়ে সবাইকে মানবিক আচরণ করার এবং তাকিদ দিয়েছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন এমন আহবান জনানো হয়, তখন তা মানুষের মধ্যে দ্রুত ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এ আহবানকে এগিয়ে নিতে প্রত্যেকেই সচেষ্ট হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানবিকতা এবং মনুষ্যত্বের বিকাশই মানব সভ্যতা টিকিয়ে রেখেছে। এর ঘাটতি হলেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা দেখা দেয়।