এদেশে রাজনীতির যে কালচার গড়ে উঠেছিল এবং নব্বই দশক অবধি বিকাশমান ছিল। যে বা যারা সেই কালচারের উত্তরাধিকারে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিলেন এবং মানুষের চোখে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেই জেনারেশনের রাজনৈতিকরা মৃত্যুতে, বয়স-বার্ধক্যে ও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে নিঃশেষিত প্রায়। উত্তরকালে গণরাজনীতির কালচারে লালিত, বিকশিত ও গড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ প্রায় অনুপস্থিত থাকায় সে চরিত্র প্রায় বিরলপ্রজাতি হয়ে উঠেছে।
গণমানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং মানুষের দ্বারা আদৃত মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনীতি সংস্কৃতির ভেতরে লালিত রাজনৈতিকরা ভোগবিলাসের বাইরে সাধারণ জীবন-যাপনের দৃষ্টান্ত তৈরী করে গিয়েছেন এবং ত্যাগের, সংযমের, সহনশীলতার চর্চার দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে একসময়ে বিকশিত করেছেন। আমাদের রাজনীতিতে সকল ইতিবাচক অর্জনগুলো সেই প্রজন্মগুলোর হাত ধরেই এসেছে।
৯০-এর দশকের পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শবাদী ধারার বিপরীতে ক্ষমতা মূখ্যতা ও ভোগবাদী রাজনীতি আধিপত্য বিস্তার করে। ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধউত্তর বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক কালচার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আরো বিকশিত হয়ে ম্যাচিউরিটি অর্জনের বদলে অবক্ষয়ী অবস্থার মধ্যে পড়ে।
পূর্বোক্ত কালচারে ধারায় লালিত ও বিকশিত রাজনৈতিকরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং অবক্ষয়ী ধারার বিপরীতে টিকে থাকতে কঠিন পরিস্থিতিতে নিপতিত হন।
৯০’এর দশক পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে প্রবল আনুগত্যবাদীতা এবং ক্ষমতা বলয়ের রাজনীতির অন্ধ অনুসারী হয়ে পড়া, রাজনীতিতে আমলা-ব্যবসায়ীদের ব্যাপক পুনর্বাসন এবং পেশাজীবি সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রকৃত সিভিল সোসাইটির ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক রুপান্তর ও অধঃপতন তরান্বিত করে।
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে সর্বক্ষেত্রে এখন অবাধ বাণিজ্যিকরণ চলেছে এবং সে ব্যবসাকরণের হাত থেকে শিল্প-সংস্কৃতি-রাজনীতি বাদ যাবে তা চিন্তা করা যায় না। তবে আমাদের মতো জনবহুল ও উদ্যমশীল রাষ্ট্রের রাজনীতি রাজনীতিবিদের বেহাত হয়ে যাওয়া মোটেও জনকল্যাণকর কিছু নয়। কেবল রাজনীতি নয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনও বেহাত হয়ে গেছে।
আদর্শবাদী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন; এ-দুটি বিষয় কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বিকাশে আবশ্যিক উপাদান। রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি দুটোই অপর লোকের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় প্রতিক্রিয়ার শক্তি লাভবান হচ্ছে এবং হবেও। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার দেউলিয়াপনার প্রণোদনা আসে সেসব ‘অপর’ হতে যাতে গণরাজনীতিটা শক্ত ভিত্তি নিয়ে দাঁড়াতে না পারে।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তোষণ নীতি, ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যবহারের কারণে পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন এবং দ্বিদলীয় রাজনীতির মুখোমুখি সংঘাতমূলক অবস্থান রাজনীতিকে জটিল আবর্তে ফেলেছিল; পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োগে ব্যর্থতা রাজনীতিবিদের কোণঠাসা অবস্থায় নিপতিত করে।
অভিজ্ঞ ও বর্নাঢ্য রাজনৈতিক অতীতের অধিকারী অনেক রাজনৈতিক তাদের ব্যর্থতার কারণেই রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেন এবং অনেকে হারিয়েও যান। রাজনীতিটা তখন পুরোপুরি সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। প্রকৃত বা ক্লাসিক্যাল রাজনীতিবিদরা আর কোনভাবেই পুরোপুরি রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
লেখকঃমোহাম্মদ হাসান,সাংবাদিক, কলামিস্ট।