ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়: রাজশাহীর ভদ্রা রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তাকর্মী তানজিলা

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

রাজশাহী ছেড়ে যাওয়া বা রাজশাহী ঢোকা প্রায় সব ট্রেনইল ভদ্রা রেলক্রসিং পার হয়। এই ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ জোড়া ট্রেন চলাচল করে থাকে। সব মিলিয়ে দিনে-রাতে মোট ৪০ বার গেট নামাতে-ওঠাতে হয়। তিন শিফটে কাজ করে তিনজন গেটম্যান। তানজিলা প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে কাজ করেন। মাসের প্রথম ১৫ দিন ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা এবং পরের ১৫ দিন দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা কাজ করেন।

কোনো সময় ট্রাফিক জ্যাম হলে ক্রসিং বার নামানোর পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্বে মানুষ ও যানবাহন সরানোর দায়িত্বও পালন করতে হয় তাকে। ২০১৮ সালে তিনি এ চাকরিতে নিয়োগ পান। চাকরির বয়স তিন বছরে পড়েছে।

জানতে চাইলে তানজিলা বলেন, তার জন্ম গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। ২০১২ সালে মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেছেন। পরে ২০১৯ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর বেশি পড়ার সুযোগ হয়নি। বর্তমানে এক মেয়ের মা তিনি। থাকেন মহনগরীর ভদ্রা এলকায় একটি ভাড়া বাসায়। সংসার চালানো, সন্তানের দেখাশোনা করা, নির্দিষ্ট সময়ে নিজের দায়িত্ব পালন করা এখন তার কাজ।

এই পেশায় কিভাবে আসলেন জানতে চাইলে তানজিলা খাতুন বলেন, কারো সঙ্গে দেখা হলেই এই বিষয়টি জানতে চায়। এই কাজটি একটু চ্যালেঞ্জিং তাই হয়তো সবাই জিজ্ঞেস করে। তবে, এই চাকরি যে করতে হবে তেমন কোনো ইচ্ছা ছিল না। অনেক আগে থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলাম। আমার স্বামী মিজানুর রহমান রাজশাহী রেলওয়েতে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করেন। তার চাকরি হওয়ার পর আমি ২০১৬ সালে রাজশাহীতে আসি। গাইবান্ধা থাকার সময় ৪-৫টি চাকরিতে আবেদন করেছিলাম।


পরে এখানে আসার পর এই চাকরিতে আবেদন করার পর নিয়োগ পাই। এজন্য এই চাকরি হাতছাড়া করিনি। কারণ নারী পুরুষ সমান সমান বা সংবিধানে যতই নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হোক না কেন, কোথাও না কোথাও আজও মেয়েদের অবহেলিতভাবে জীবনযাপন করছে। কোথাও যেন একটা ছেদ রয়ে গেছে। আজও মেয়েরা নিজের শর্তে বাঁচতে পারেন না। প্রাচীনকালে ঠিক যে সময় থেকে সমাজে নারী-পুরুষ বিভাজন এবং ব্যক্তি সম্পত্তির উদ্ভব ঘটেছে, তখন থেকেই পুরুষের আধিপত্য বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করছে। তবে, এখনও নারীদের কাজ পাওয়া কঠিন।

তানজিলা বলেন, শুরুর দিকে স্বজনদের মধ্যে অনেকে নিরুৎসাহিত করেছেন। বলেছেন, এই কাজ আমি পারবো না। আমাকে হেনস্তার শিকার হতে হবে। আমি ভাবলাম, আমি যদি কাজ না করেই ভেবে বসে, আমি পারবো না, তাহলে তো হলো না। কাজ না করে ভয় পাওয়ার তো কোনো মানে হয় না। আগে কাজ করে দেখি পারবো কিনা, পরে না হয় ভেবে দেখা যাবে। ভালো না লাগলে পরে চাকরি ছেড়ে দেবো। এই ভেবে কাজ শুরু করলাম। এই আসছে ১৩ মার্চ আমার চাকরির ৩ বছর পূর্ণ হবে। আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব করি। কারণ আমি ছোট-বড় যাই হোক একটা কাজ করি।

তানজিলার কাজে সময় সহায়তা করেন তার স্বামী। তানজিলা বলেন, আমার স্বামী আমাকে সহায়তা করেন। পরিবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চাকরি করার ক্ষেত্রেও তিনি অনেক সহায়তা করেন। এই চাকরি করার জন্য মূলত তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। আমার একটি ছোট মেয়ে আছে। সে নার্সারিতে পড়ে। চাকরির পাশাপাশি তাকেও দেখাশোনা করতে হয়। সবমিলিয়ে কাজের মধ্যে থাকতে ভালোই লাগে।

লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে সবসময় সতর্ক থাকতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এটা শহরের প্রবেশমুখ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ও যানবাহন চলাচল করে। এজন্য সবসময়ই সতর্ক থাকতে হয়। অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। গেট খুলতে মাত্র ২-৩ মিনিট সময় নিলে অনেকে খারাপ মন্তব্য করেন। আবার অনেকে নিজেরাই গেট খুলে চলে যান।

এসব বিষয় নিয়ে মানুষের সঙ্গে হরহামেশাই তর্ক-বিতর্ক হয়। ধীরে ধীরে কাজ শিখে গিয়েছি। এ বিষয়গুলোতে এখন অভ্যস্ত। স্থানীয়ও আমার কাজে সহায়তা করে। কোনো সমস্যায় পড়লে তারা নিজেরাই এগিয়ে এসে আমার পক্ষে দাঁড়ায়।

কাজ করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় জানিয়ে তানজিলা বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভালো-খারাপ মন্তব্য শুনতে হয়। গেট খুলতে একটু সময় নিলেই অনেকে বলেন, আমি মেয়ে বলে কাজ পারি না। এই লেভেল ক্রসিংয়ে দুটি গেট। একটি গেট খুলে অন্য গেটের দিকে যেতে স্বাভাবিকভাবে ২-৩ মিনিট সময় লাগে। এটুকু সময় অনেকে অপেক্ষা না করে মন্তব্য করে বসে। অনেক সময় মানুষের কথায় খারাপ লাগে। শুরুর দিকে এই বিষয়গুলো বেশি সম্মুখীন হয়েছি। এখন আর সমস্যা হয় না।


‘নিজের যোগ্যতায় আমি চাকরি পেয়েছি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে এমন মন্তব্য করে মেয়েরা সবকিছুই করছে। ছেলেরা কাজ পাচ্ছে না মেয়েদের জন্য। আমি তাদেরকে বলি আমি যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পেয়েছি। আমি যখন চাকরি পায় তখন রাজশাহী রেলওয়ে ৮৫১ জনকে নিয়োগ দিয়েছিল। তার মধ্যে ৫১ জন ছিল নারী। নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ দিয়ে আমরা চাকরি পেয়েছি। ছেলেদের বাদ দিয়ে আমাদের নিয়েছে এমন নই। যে যোগ্য তাকে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সমাজে ভালো মানুষ যেমন আছে, খারাপ মানুষও আছে। কারো মন্তব্যে কানে না দিয়ে নিজের কাজ করে যাওয়াই উত্তম। কে কি বলছে সেটা দেখার দরকার নেই। আমি কি করছি, কি ভাবছি, সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ।

তানজিলার বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব কাজই করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাদের সমাজের নারীরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কাউকে হয়তো তার পরিবার পাড়া-প্রতিবেশীরা সহায়তা করে না কিংবা স্বামী সহায়তা করে না। আমার স্বামী আমাকে সহায়তা করেছে বলে আমি এই কাজ করতে পারছি। কিন্তু সবার স্বামী তো এমন না। মেয়েদেরও কাজে সুযোগ দেওয়া উচিত। মেয়ে বলে যে কিছু করতে পারবে না, এমনটা ভাবা উচিত না। ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored