রিজেন্ট এয়ারওয়েজ দেশের একটি পুরনো বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা। এটি হাবিব গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত সাহেদ করিম এই এয়ারওয়েজ তাঁর গ্রুপের বলে প্রচার করতেন। আবার ‘রিজেন্ট গ্রুপ’ নামে চট্টগ্রামের একটি কম্পানি আছে, যেটি ১৯৮৮ সালে রেজিস্টার্ড অব জয়েন্ট স্টক কম্পানি থেকে নিবন্ধন করা। আবাসন ব্যবসায় যুক্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কক্সবাজারের জমিতে টাঙানো সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে ‘ফিল্ড ভিজিট’ বলে প্রচার করেছেন সাহেদ। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়াতেন সাহেদ পরিচিত চালকদের দিয়ে, সেই চালককে দেওয়া হত সাজানো এই দুর্ঘটনাপিছু আট হাজার টাকা, চাপা খাওয়া সেই পথচারীকে হাসপাতালে এনে চলতো দুর্ঘটনা বানিজ্য!
প্রতারক সাহেদ অনেকের কাছেই রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে তাঁর প্রতিষ্ঠান বলে প্রচার করতেন। তাঁর অপকর্ম ফাঁস হওয়ার পর রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষও বিব্রত। তারা সাহেদের এই প্রতারণার বিচার চেয়েছেন। আবার একই নামে সাহেদ কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান খুললেন, তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে তদন্তে একের পর এক অপকর্মের তথ্য পাওয়া গেলেও গতকাল রবিবার পর্যন্ত ধরা পড়েননি সাহেদ করিম। ঈদুল আজহা উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন
সাহেদের জালিয়াতির হাত রিকশা পর্যন্তও নেমে এসেছে। তাঁর প্রতারণা থেকে রেহাই পায়নি রিকশাচালকরাও। গত শনিবার তাঁর কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাসপোর্ট ও কম্পিউটারের সঙ্গে সাহেদের নামে করা অন্তত ৫০০ রিকশার লাইসেন্স জব্দ করেছেন তদন্তকারীরা। এসব লাইসেন্স রিকশাচালকদের দিয়ে প্রথমে দুই হাজার এবং প্রতি মাসে ৫০০ করে টাকা আদায় করতেন সাহেদ।
রিজেন্টের সাহেদ করিমের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় গ্রেপ্তার করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি উদ্ঘাটনের পর কেউ তাকে শেল্টার দেয়নি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তার অপরাধ বের করেছে। সে কী করেছে, সেগুলো র্যাব ও পুলিশ তদন্ত করছে। তাকে অবশ্যই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
একই অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘তাকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সাহেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করি দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’
সাহেদের সহযোগী তরিকুল ইসলাম শিবলীসহ আট কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। ছায়া তদন্ত করছে র্যাব। তদন্তের সূত্র ধরে শনিবার তাঁর কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে পাসপোর্ট ও একটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কসহ কিছু আলামত জব্দ করা হয়।
হাজার কোটি টাকার প্রতারণা ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত সাহেদের কবল থেকে দরিদ্র রিকশাচালকরাও রেহাই পায়নি। সাহেদের কার্যালয়ে প্রায় ৫০০ রিকশার লাইসেন্স পাওয়া যায়। তুরাগের হরিরামপুর ইউনিটের চেয়ারম্যান ও সচিব স্বাক্ষরিত লাইসেন্সগুলো সাহেদের নামে ইস্যু করা। উত্তরা ও তুরাগ এলাকায় চলা রিকশার জন্য এই লাইসেন্স দিতেন সাহেদ। এ জন্য রিকশাচালকদের কাছ থেকে প্রথমেই দুই হাজার টাকা এবং প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিতেন সাহেদ। কেউ টাকা না দিলে ভয় দেখাতেন, নির্যাতনও করতেন।
এদিকে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর আবদুল্লাহ আল মুকিত বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নামের মিল থাকায় বিতর্কিত একটি হাসপাতালের সঙ্গে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সম্পৃক্ততা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। হাবিব গ্রুপ চট্টগ্রামভিত্তিক একটি স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতাল বা রিজেন্ট গ্রুপের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
রিজেন্ট হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পরিচিতি দিতে গিয়ে সাহেদ রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে নিজের প্রতিষ্ঠান বলে প্রচার করতেন। আবার কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইমামের ডেইল এলাকায় চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপের সাইনবোর্ড লাগানো কিছু জমি রয়েছে। সেই জমির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক পেজে আপলোড করে তা নিজের দাবি করেন। বাস্তবে তা চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপের মালিক সাবেক রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামের গোলাম আকবর খন্দকারের।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় কয়েকজন গাড়িচালকের সঙ্গে চুক্তি ছিল সাহেদের। তারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথচারীকে চাপা দিয়ে রোগী বানিয়ে গাড়িতে করে তাঁর হাসপাতালে রেখে চলে যেত। এভাবে একজন রোগী রেখে দিতে পারলে তাকে দেওয়া হতো আট হাজার টাকা করে। আর অচেতন অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকিয়ে তাঁর স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন সাহেদ। কয়েকজন ভুক্তভোগী পুলিশ ও র্যাবের তদন্তকারীর কাছে এ ভয়ংকর অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, কয়েকজন চালককে টাকার লোভ দেখিয়ে সাহেদ এই ভয়ংকর অপকর্ম চালাচ্ছিলেন। তাঁর হয়ে রিজেন্ট হাসপাতালে জনসংযোগ কর্মকর্তা তারেক শিবলী এ লেনদেন করতেন। আইসিইউয়ের প্রয়োজন নেই সামান্য আহত এমন কয়েকজন রোগীকে দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে আটকে রেখে তাঁদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করায় স্বজনরা সন্দেহ করেন। পরে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং হাসপাতালে বহন করে নিয়ে যাওয়া চালকদের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালে যোগাযোগের তথ্য পান ভুক্তভোগীরা। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।