১৯৮১ থেকে ২০২০। এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়াও মৃত্যুবরণ করেন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ কেন্দ্রীয় বহুসংখ্যক সদস্য। যাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীও রয়েছেন।
শেখ হাসিনাপূর্ব আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মালেক উকিল মৃত্যুবরণকারী প্রথম নেতা। তিনি ৮৭ সালে মারা যান। আর সর্বশেষ মৃত্যুবরণকারী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন এম কোরবান আলী। তিনি ৮৪ সালের ৯ জুলাই এরশাদের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন এবং ৮৯ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।
এদের কেউ আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনাস্থা জানিয়ে দল ছেড়েছেন, কেউবা পাল্টা দল করেছেন। হালে পানি না পেয়ে কেউ কেউ মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে রাতারাতি এরশাদের দলে ভিড়েন। ‘৮৩ সালে দলও ভেঙেছে। আবার ফিরেও এসেছেন।
প্রেসিডিয়াম সদস্য বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মমিন তালুকদারও মারা যান এরপরই। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সালাউদ্দিন ইউসুফ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও এককালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ মন্ত্রী মতিউর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, মতিউর রহমান ও অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানসহ মহিউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, পুলিন দে, ডা. আলাউদ্দিন, ড. মোহাম্মদ সেলিম, আতাউর রহমান খান কায়সার আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো শেখ হাসিনার আমলেই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
২০২০ সালের ১৩ জুন প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর একদিন পর ১৪ জুন সিলেটের প্রথম মেয়র বদরুদ্দীন কামরান। আর ২৩ জুন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহও মারা যান। ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু দিয়ে শুরু হয় এ দশকের মৃত্যুর মিছিল। ২০১১ থেকে ২০২০ এই সময়ের মধ্যে পরপারে চলে গেছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, এককালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার, মোহাম্মদ নাসিম ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তারা প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। পরলোকে যাওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রেসিডিয়াম পদ গ্রহণের প্রস্তাব বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও ইন্তেকাল করেছেন। ক’দিন আগে এককালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মান্নানও চলে গেলেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুর রাজ্জাক ক্যান্সার ও কিডনিজনিত কঠিন রোগে আক্রান্ত হবার পর আব্দুল জলিল চিকিৎসার্থে দুই কোটি টাকা দিয়েছিলেন, কিন্তু কোন অর্থকড়িই দিয়েই জনপ্রিয় নেতা আব্দুর রাজ্জাককে বাঁচানো যায়নি। বরং ২০১৩ সালের ৬ মার্চ ইন্তেকাল করেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলও। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আব্দুল জলিলের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছিলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস এর মাত্র দু সপ্তাহের মাথায় ২০ মার্চ ইন্তেকাল করেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। জাতীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধ কালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দু-দুবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দল মহাবিজয় লাভ করলেও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি পাঁচ নেতাই। আব্দুল জলিল সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বাদ পড়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও নিশ্চুপ ছিলেন অন্য চার নেতা। সংবিধান সংশোধন খসড়া কমিটির কো-চেয়ারম্যান হয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাফল্য দেখানোয় পুরস্কার স্বরূপ রেলমন্ত্রী হন। কিন্তু ভাগ্যবিমুখ হলে যা হয়। তাঁর এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রীত্বে তিনি দফতরবিহীন হয়ে যান। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চলে যান মহাপ্রয়াণে।
জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল জলিল ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোট ৬ জন। তার মধ্যে সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও বেশকিছু দিন ধরে অসুস্থ। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও লাইফ সাপোর্ট থেকে বেঁচে গেছেন। বর্ষীয়ান নেতাদের মধ্যে আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ বেঁচে আছেন। যদিও এই দুই নেতা প্রেসিডিয়ামে নেই। প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আব্দুল জলিলের সঙ্গেই ওয়ার্কিং কমিটি থেকে ছিটকে পড়েন তাঁরা। ঠাঁই হয় উপদেষ্টা পরিষদে।
আব্দুর রাজ্জাক ও আবদুল জলিলের মৃত্যুর পর আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী ও তোফায়েল আহমেদ বানিজ্যমন্ত্রী হন। অবশ্য বর্তমান মন্ত্রিসভায় তাদের ঠাঁই হয়নি। স্থান হয়নি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামেও। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর কারণে ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক পদটি শূন্য হয়। যে পদে গতকাল নিয়োগ পেয়েছেন আমির হোসেন আমু। ধারণা করা হচ্ছে দলের নেতাদের শূন্যতা পূরণের জন্য অচিরেই আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হতে পারে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি
আব্দুল মান্নান ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। বদরুদ্দীন কামরান মারা যান ২০২০ সালের ১৪ জুন। চট্টগ্রামের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ইহলোক ত্যাগ করেন ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মকবুল হোসেন ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য হাবিবুর রহমান ক’দিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেন।
এছাড়াও মৃত্যুপুরীর দেশে চলে গেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান খান শাজাহান ও আজিজুর রহমান। আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে পরলোকে চলে গেছেন, দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুর রহমান খান শাহজাহান, মৌলভীবাজারের আজিজুর রহমান। প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন (এরশাদ মন্ত্রী) দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আহমদ, শ্রম সম্পাদক কাজী মোজাম্মেল হক, কৃষি সম্পাদক মানিক চৌধুরী, সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ইয়াহিয়া চৌধুরী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক এস এম ইউসুফ, তথ্য গবেষণা সম্পাদক শফিকুল আজিজ মুকুল, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, এককালীন শ্রম সম্পাদক চট্রগ্রামের রহমতুল্লাহ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক ফজলুল হক বিএসসি, আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কে এস নবী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আলমগীর কুমকুম, মহিলা সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ দফতর সম্পাদক সিদ্দিকুর রউফ খান, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নাজমা রহমান, ধর্ম সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ, সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এককালীন সহসভাপতি আব্দুর রহিম, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগের এককালীনসহ সভাপতি কাজী জহিরুল কাইউম, বঙ্গবন্ধু সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর, লুৎফর রহমান, রওশন আলী, এ কে এম শামসুজ্জোহা, আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, কর্নেল শওকত আলী, জহিরুল ইসলাম, মাহামুদুল হাসান খান, হরনাথ বাইন, ইয়াহিয়া চৌধুরী পিন্টু, গাজী আজহার উদ্দিন, এসে এম নূরুন্নবী, মীর্জা সুলতান রাজা, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, সদস্যদের মধ্যে ঢাকার প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, ফজলুল করিম, আব্দুর রউফ চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সিদ্দিক হোসেন, ইউনুস আলী অ্যাডভোকেট, এবিএম তালেব আলী, মতিউর রহমান তালুকদার, ইমাম উদ্দিন আহমেদ, রহমত আলী, সুধাংশু শেখর হালদার, এম এ মান্নান, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, শেখ হারুন উর রশীদ, বিপুল ঘোষ, মোস্তফা ফারুক, মোস্তফা রশিদী সূজা, হাবিবুর রহমান মোল্লা, শরফুদ্দিন আহমদ ঝন্টু ও আব্দুল আওয়াল প্রমুখ।
১৯৭৭ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার ইডেন হোটেলে যে কাউন্সিল হয় যুগ্ম আহবায়ক হওয়া মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমেদও বেঁচে নেই। মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও তারা অনেকেই আওয়ামী লীগে পদে আসীন হয়েছিলেন। এরা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুরও মন্ত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে জেনারেল ওসমানী, ফণীভূষণ মজুমদার, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মমিন, সোহরাব হোসেন, আসাদুজ্জামান খান, মনোরঞ্জন ধর, প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ডা. ক্ষীতিশচন্দ্র মন্ডল।
এছাড়াও সেই আহবায়ক কমিটির সদস্যদের মধ্যে মারা গেছেন মোল্লা জালাল উদ্দিন, মতিউর রহমান, ফণীভূষণ মজুমদার, কাজী জহিরুল কাইউম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মমিন, সোহরাব হোসেন, আসাদুজ্জামান খান, মনোরঞ্জন ধর, দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ড. ক্ষীতিশ চন্দ্র মন্ডল, ময়েজউদ্দিন আহমদ, ফজলুল করিম, মোহাম্মদ হানিফ, আনসার আলী, শামসুর রহমান খান শাজাহান, ব্যারিস্টার শওকত আলী, আহমদ আলী, আলী আজম ভূঁইয়া, নূরুল ইসলাম, আব্দুল হাকিম, খন্দকার আবুল কাশেম, বদিউজ্জামান, আজিজুর রহমান, খন্দকার আবু তালেব, এ কে মজিবর রহমান, মোহাম্মদ মোহসীন, সৈয়দ কামাল বখত, এম এ ওয়াহাব, বেগম মাহমুদা চৌধুরী ও রওশন আরা মোস্তাফিজ। অনুসন্ধানে উল্লেখিত আওয়ামী লীগ নেতারা সকলেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তবে দুই একটি সূত্র দু’চার জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে যা অসমর্থিত।
মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগদান থেকে বিরত থাকা বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে মোল্লা জালাল উদ্দিন, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মতিউর রহমান প্রমুখ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও মিজান চৌধুরী পাল্টা আওয়ামী লীগ করে পরে এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হন। পরে আওয়ামী লীগে ফিরে উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হন। মতিউর রহমান প্রেসিডিয়াম থেকে বাদ পড়ে বিএনপি যোগ দিয়ে এমপি প্রার্থী হলেও পরাজিত হন। তিনিও মারা গেছেন।