শামসুদ্দিন মোল্লার আজ মৃত্যু দিন। আজ থেকে ২৯ বছর আগে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। অনেকেই হয়তো মনে রাখেননি প্রয়াত এই মহান মানুষটিকে। পচাঁত্তর সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৩ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে প্রথম যে মিছিল বের হয়েছিলো সে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সংগঠিত করেছিলেন তিনি।আজো মনে পড়ে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সে ছবিটির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির দিকে।সেনা শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে,জীবনের পরোয়া না করে মিছিল এগুচ্ছে কাটাবন-এলিফ্যান্ট রোড,সায়েন্স ল্যারেটরী হয়ে ধানমন্ডির দিকে। মিছিল যত এগুচ্ছে বাড়ছে লোক সংখ্যা। মিছিলের খবর শুনে একের পর এক আসতে থাকে সেনাবাহিনীর গাড়ী। মিছিল আটকাতে চেষ্টা করে। লোক সংখ্যা বাড়তে থাকায় পিছু হটে সেনাবাহিনী। মিছিলের সামনে বঙ্গবন্ধুর একখানা ছবি বুকে নিয়ে হাটছেন শামসুদ্দিন মোল্লা। সে ছবিটিই ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিলো।
প্রয়াত শামসুদ্দিন মোল্লা ব্যাক্তি জীবনে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বন্ধু। তাঁরা কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ বর্তমানে যার নাম মাওলানা আজাদ কলেজে একই ক্লাসে পড়াশোনা করতেন।থাকতেনও এই জায়গায় বেকার হোষ্টেলে। বঙ্গবন্ধু ও শামসুদ্দিন মোল্লা থাকতেন একই রুমে। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর আরো কয়েকজন ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন,তারা হলেন ফরিদপুরের প্রয়াত সরোয়ারজান মিয়া,সৈয়দ নুরুল হক,এবং যশোরের সিরাজউদ্দিন হোসেন,যিনি পরবর্তীকালে সরাসরি রাজনীতিতে না এসে সাংবাদিকতা করতেন,ইত্তেফাকের নিউজ এডিটর ছিলেন। একাত্তরে খান সেনাদের হাতে নিহত হন। সিরাজউদ্দিন হোসেন বিয়ে করেছিলেন তার বন্ধু শামসুদ্দিন মোল্লার বোন।
এরা বৃটিশ ভারতে সবাই এক সঙ্গে যুব মুসলিম লীগ করতেন। দেশ ভাগের পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসিলম লীগ পরে আওয়ামী লীগের নেতা হলে তার পুরানো বন্ধুদের মধ্যে শামসুদ্দিন মোল্লা ও সিরাজউদ্দিন হোসেন চলে আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে,সরোয়ারজান মিয়া ও সৈয়দ নুরুল হকরা থেকে যান মুসলিম লীগে। শামসুদ্দিন মোল্লা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধারন করে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বাকশাল পদ্ধতি চালু করার সময়ে ফরিদপুর জেলার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন।
জাতীয় সংসদে দেয়া তার ভাষনগুলো পড়লে দেখা যায় তিনি বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে যে বক্তব্য দিয়েছে আজো তা দারুনভাবে প্রাসাঙ্গিক। সে সময়ে তিনি নদী খনন করে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা প্রয়োগের কথা বলেছেন। এ বিষয়ে শামসুদ্দিন মোল্লা অকপটে বলতেন আমি কৃষক পরিবারের সন্তান,আমি মনে করি কৃষককের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
৩ নভেম্বর শামসুদ্দিন মোল্লা মিছিলের নেতৃত্বে দিয়ে যখন বত্রিশ নম্বর বাড়িতে পৌছান তখোন তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে সেনাবাহিনী। হাজার হাজার লোক তখোন বিত্রশ নম্বর বাড়ির গেট ধরে আঝোরে কাদঁছে। কথা ছিলো ওই দিন শামসুদ্দিন মোল্লা প্রতিবাদের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষনা দেবেন। বাধ সাধে সেনাবাহিনী। তারা শামসুদ্দিন মোল্লার কাছ থেকে কর্মসূচীর কাগজ ছিনিয়ে নেয়। পরে কৌশল করে শামসুদ্দিন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর জন্য দু’হাত তুলে মোনাজাত করেন এবং মোনাজাতের মধ্যদিয়ে পরবর্তী কর্মসূচীও জানিয়ে দেন। নেতারা যখন ওই কর্মসূচী শেষ করেন তখনই তাদের কাছে খবর আসে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এগুতে থাকেন জেলখানার দিকে কিন্ত যেতে পারেননি। ওই দিনই বিকেলে সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ঢাকায় শহরে মাইকিং করে ঘোষনা দেন,শামসুদ্দিন মোল্লা,তার ছেলে শহরিয়ার রুমি,যশোরের রওশন আলী ও ইসমত কাদের গামাকে দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করা হবে।
যশোরের রওশন আলী ভারতে চলে যান। তারা ভারতে গিয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। ওই সময়ে ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন শরন সিং। তিনি এসে এদের সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেন। জীবন বাচানোর জন্য ওই সময়ে পশ্চিম বাংলায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় প্রতিটি রাস্তার মাঠি কেটে জীবন চালাতে হয়েছে শামসুদ্দিন মোল্লাসহ অন্যদের। ৩ নভেম্বরের ওই মিছিলে আরো ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, ফরিদপুরের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন।ছাত্র নেতাদের মধ্যে ইসমত কাদির গামা, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম,বাহলুল মজননুন চুন্নু,মুকুল বোস সহ অনেকেই।
দীর্ঘদিন ভারতে প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরেন শামসুদ্দিন মোল্লা। তার সন্তানদের মধ্যে কামরুজ্জামান কাফি রাজনীতির শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় যুব লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। কাফি একজন নির্ভেজাল মানুষ হিসেবে পরিচিত। পিতার মতই বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতিই তার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। মহান আল্লাহর কাছে এই প্রয়াত মহান নেতা শামসুদ্দিন মোল্লার আÍার মাগফেরাত কামনা করি।ব্যাক্তি জীবনে তিনি ছিলেন আমার রাজনৈতিক অভিভাবক।