২০১৮ সালের সংক্রামক ব্যাধি আইনের আওতায় এখন ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। না মানলে পরিষ্কারভাবেই শাস্তির বিধান রয়েছে। একই আইনের আওতায় শারীরিক দূরত্ব না মানা বা সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও শাস্তির কথা বলা আছে। অন্তত ছয়টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে এই আইন বাস্তবায়নে পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রয়োগ করার কথা। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে কমবেশি সবাই শৈথিল্য দেখাচ্ছে বলে মনে করছে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
গত রোজার ঈদের সময় নির্দেশনা ছিল শপিং মল না খোলার জন্য। এ ছাড়া ওই ঈদের সময় ঢাকা শহরের বাইরে যাতায়াতেও মানা করেছিল কারিগরি কমিটি; ঈদুল আজহার সময়ে একই সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এসবের অনেক কিছুই থেকে গেছে কেবলই কাগজে-কলমে। হচ্ছে না বাস্তবায়ন। একশ্রেণির মানুষের যেমন নেই সচেতনতা, তেমনি সংক্রমণ প্রতিরোধে দেখা মিলছে না আইনের কোনো রকম প্রয়োগ। দেশে সংক্রমণ প্রত্যাশিত হারে নিয়ন্ত্রণে না আসা কিংবা কোরবানি ঘিরে আরো সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে জাতীয় পরামর্শ কমিটির সদস্যরা এসব কারণে কমপক্ষে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের শৈথিল্য ও সমন্বয়হীনতাকে চিহ্নিত করেছেন। এই বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সংক্রমণের শুরু থেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি মন্ত্রণালয়ের নানা ধরনের দায়িত্বহীনতা, সমন্বয়ের ঘাটতি ও শৈথিল্যের নজির দেখা যাচ্ছে। যার পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে দেশের লাখো মানুষকে। গত ১০ জুলাই কভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভায়ও এসব বিষয়ে আলোচনা হয় এবং সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়। পরামর্শক কমিটির সদস্যদের মতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।
সময়ে মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থেকে শুরু করে সরকারের নিয়মিত বুলেটিনসহ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে গণমাধ্যমে সতর্কতা উচ্চারণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নির্দিষ্ট সময়ের পরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, কেবল জরুরি প্রয়োজনে বিদেশ যাওয়া, হাটবাজার-রেস্টুরেন্ট-দোকাপাট পরিচালনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ আরো সব সতর্কতামূলক নির্দেশনা প্রচারের কমতি নেই। সর্বশেষ জাতীয় পরামর্শ কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে ঢাকার দুই সিটি, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকাসহ দেশের কোনো শহর এলাকার ভেতরে কোরবানির গরুর হাট না বসাতে।
দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধে কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একা কাজ করলে চলবে না, বরং মাঠপর্যায়ে অনেক কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও। বিশেষ করে পাঁচ-ছয়টি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি—এসব মন্ত্রণালয়ের কাজে অনেকটা শৈথিল্যের কারণেই দেশে সংক্রমণ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঘুরছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নীতিনির্ধারণ, রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিত্সাব্যবস্থা নিয়ে যতটা দায়িত্ব পালন করবে—মাঠপর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে, স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করতে তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব বর্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। সেই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংক্রমণ রোধে পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়—তথা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদ। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিসরকে সীমিত রাখা-স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায় অনেক বেশি। বিদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে উচ্চতর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে কাউকে দেশে ফিরিয়ে না আনার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তা ছাড়া জরুরি কারণে আকাশপথে দেশে আসা বা যাওয়ার ক্ষেত্রে বিমানবন্দরগুলোর ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বিমানে যাত্রী ব্যবস্থাপনা, তাদের উপযুক্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাইসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো দেখভাল করবে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
পথেঘাটে যেভাবে মানুষজন বেপরোয়া হয়ে অসতর্কভাবে বা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা করছে, সেটা বন্ধে আমরা তো মাঠে নেমে কিছু করতে পারব না। এ কাজ করবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমরা তাদের এ বিষয়ে জানিয়েছি। সিটি করপোরেশনও এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সহায়তা করার কথা। কিন্তু এগুলো কিছুই দেখছি না। বিদেশ থেকে কে আসে-যায় সেটাও তো আমাদের দায়িত্ব না। এখন সবই যদি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না।’
সবার আগে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। নয়তো আইন প্রয়োগ করে সব কিছু হয় না। মানুষকে আরো সচেতন করতে প্রচার চালানো উচিত।
সংক্রামক ব্যাধি আইনের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর দায়িত্বের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওই আইনে আমাদের কোনো ক্ষমা দেওয়া হয়নি। বরং আমরা এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা চেয়েছি। এখন যা আছে সেটা কেবল স্বাস্থ্য বিভাগ আমাদের অনুরোধ করলে আমরা তা পালনের চেষ্টা করতে পারি। ওই আইনের শাস্তিও খুবই কম।’
আমরা কোরবানির হাটের সংখ্যা কমানোর পক্ষে নই। এবার হাটের সংখ্যা কমবে না। তবে সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট আকারে হাট বসানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। শহর অঞ্চল ছাড়াও গ্রামগঞ্জে একটি বা দুটি জায়গায় কোরবানির পশু বেচাকেনা করার জন্য নির্ধারণ না করে একটি ওয়ার্ডে বা ইউনিয়নে বিস্তৃত স্থানে আয়োজন করলে করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখবে। এতে করে একদিকে যেমন পশু কেনাবেচার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে করোনার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এ বছর ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি। এ প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের কোথায় কতটা হাট বসবে তা স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করবে। এ বিষয়ে মাঠ প্রশাসনই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যেসব এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি বা যে এলাকাগুলোকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেসব এলাকায় পশুর হাট বসানো বর্জন করার আহ্বান জানান তাজুল ইসলাম।
আমরা সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়েই কভিড মোকাবেলায় সক্রিয় দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। এমনকি এখন ৬৮ জন সচিবের অংশগ্রহণে কভিড ও বন্যা মোকাবেলার বিষয়ে এক সভা চলছে। সেখানেও আমি সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি কভিড মোকাবেলায় এগিয়ে আসার জন্য।’
করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে সর্বশেষ গত ৩০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে আগের প্রজ্ঞাপন অনুসারে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত করা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে যেভাবে সীমিত পরিসরে অফিস চলছে, তা আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহনও চালু থাকবে। পাশাপাশি সবার মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক বলেও জানানো হয়।
গত ১০ জুলাইয়ের জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভায় কভিড-১৯-এর সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে না আসা সত্ত্বেও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধ জীবনযাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কমিটি ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পরামর্শ দেয়। ঈদুল আজহা উপলক্ষে শহরের ভেতরে পশুর হাট না বসানো এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পশু কেনাবেচার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেয়। সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, অন্যান্য জায়গায় সংক্রমণ প্রতিরোধ নীতিমালা পালন সাপেক্ষে কোরবানি পশুর হাট বসানো যেতে পারে। কোরবানি পশুর হাট স্থাপন ও পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম পালন করার জন্য বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, পশুর হাট খোলা ময়দানে হতে হবে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। বয়স্ক ব্যক্তি (৫০ বয়সোর্ধ্ব) এবং অসুস্থ ব্যক্তির পশুর হাটে যাওয়া যাবে না। হাটে প্রবেশ ও বের হওয়া পৃথক রাস্তা থাকতে হবে। পশুর হাটে আসা সব ব্যক্তির মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। পশু জবাই বাড়িতে না করে শহরের বাইরে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে করতে হবে। অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে বাড়ির বাইরে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হলে তা করার জন্য উত্সাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব না দিয়েই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১টি কোরবানির পশুর হাট চালুর অনুমতি দিয়েছে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ।