বিভাগ সারাবাংলা

মানব পাচারকারীর ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। হারিয়ে যাওয়ার বিপদ। মৃত্যুভয়। কোনো কিছুই যেন বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না হতদরিদ্র মানুষেরা।

তারা এখনো প্রহর গুনছেন-ঘরে ফিরবে সন্তান। তাদের কান্না এখনো থামেনি। তবে কান্না না থামলেও মানব পাচারকারীর ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধ হয়নাই।টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে গড়ে তুলেছে তারা নতুন আস্তানা। বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর ফের চালু হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলের নোয়াখালীপাড়ার কাটাবনিয়া-কচুবনিয়া ঘাট। এখান থেকেই ট্রলারে উঠতে হয় বলে এসব ঘাট ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামেই পরিচিত। বিনা টাকায় বিদেশ পাড়ির গল্প দিয়ে নিরীহ মানুষদের এই ‘এয়ারপোর্ট’ থেকে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রলার নামের মরণযানে। এর পরের ঘটনা শুধুই বর্বরতার।

মানব পাচারকারীর ফাঁদে পড়ে মৃত্যুকে কবুল করেই তারা ট্রলারে চেপে বসছে। পৌঁছে যেতে চায় স্বপ্নের ঠিকানা মালয়েশিয়ায়। এসব পথেই টেকনাফ-উখিয়াসহ সারা দেশের হাজারো তরুণ, যুবক দেশ ছেড়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। কারও খোঁজ মিলেছে। কারও মেলেনি। যাদের খোঁজ মেলেনি তারা কী অবস্থায় আছেন, জানে না কেউ। অজানা আশঙ্কা কাটেনি পরিবারের সদস্যদের।

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে সম্প্রতি টেকনাফের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী ও শিশুসহ শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের কাছে একটি ট্রলার ডুবে যায়

পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে পড়ে রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গত মাসেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন মানব পাচারকারী। এর পরেও পাচার বন্ধ হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি শিথিল হলে পাচার আবারও বেড়ে যায়।

২০১৫ সালে তাদের ফাঁদে পড়ে পাচার হওয়ার সময় ১২ জনকে উদ্ধার করেছিল র‌্যাব-১২। এরপর দীর্ঘ তদন্তের পর গত ৩০ জুন টাঙ্গাইলের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। তারা প্রত্যেকেই এখন কারাগারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইল থেকে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব। তদন্তে জানা যায়, তারা বিনা পয়সায় মালয়েশিয়া পাঠাবে বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোক সংগ্রহ করে সাগরপথে মাছ ধরার ট্রলারে করে পাচার করত। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ নিরীহ লোককে বিনা পয়সায় মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ করত।

টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীদের প্রথমে চট্টগ্রাম নিয়ে আসত। এরপর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে নিয়ে আসে। টেকনাফ থেকে ধাপে ধাপে তাদের মালয়েশিয়াগামী মাছ ধরার ট্রলারে উঠায়। ট্রলারে উঠানোর পর থেকেই যাত্রীদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতন ও অনাহারে যাত্রীদের মধ্যে কোনো যাত্রী গুরুতর অসুস্থ বা মৃত্যুবরণ করলে তাদের সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়। মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জলসীমায় ট্রলার পরিবর্তন করে যাত্রী হস্তান্তর করা হয়। এভাবে মালয়েশিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছার আগেই জীবিত সব যাত্রী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মানব পাচারকারী দলের সদস্যরা প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করে। সমুদ্রপথে পাঠানো যাত্রীদের মালয়েশিয়ায় গ্রহণ করত তারা। যাত্রীদের গ্রহণ করার পর মালয়েশিয়ার সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে টর্চার সেলে নিয়ে যেত। ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাইত। যারা টাকা দিতে পারত না, তাদের ক্ষেত্রবিশেষে সাগরে ছুড়ে ফেলা বা নির্যাতন করে পঙ্গু করে দিত এই চক্রের সদস্য। মালয়েশিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের জলদস্যুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে এই টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছিল বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে; যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সাগর পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি।

২০১৫ সালের সাগরযাত্রীদের বেশির ভাগই ছিল পুরুষ, কিন্তু ২০১৮ সালের যাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুরনো রুটেই আবারও পাচারকাজ শুরু হয়েছে। টেকনাফের সাগর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। এরমধ্যে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া; মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফের বাহারছড়া, নোয়াখালী, শাহপরীরদ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফল-ী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও পটিয়া উল্লেখযোগ্য। সূত্র জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শীর্ষ মানব পাচারকারীরা স্থান পরিবর্তন করে পাহাড়কেই নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেঁচে নিতে শুরু করেছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার মধুরছড়ার মাছকারিয়া গভীর অরণ্যের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ড পাহাড়ে গণকবরের সন্ধান এবং টেকনাফ-উখিয়ার পুলিশের গুলিতে চার মানব পাচারকারী নিহত হওয়ার পর থেকে মানব পাচারকারীরা স্থান পরিবর্তন করে কৌশলে পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা

ঢাকা, ২৪ আগস্ট ২০২৫: পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. ফাইজুর…

August 24, 2025

বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া সভাপতি ফারুকের প্রায় ১২০ কোটি টাকা ট্রান্সফার!

বিসিবির ফিক্সড ডিপোজিট নিয়ে বিশাল আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে! ক্রিকেট বোর্ডের…

April 24, 2025

২০০৯ এর বিডিআর বিদ্রোহ এবং ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি

"২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় প্যারাশুট রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সান্ধু সেদিন "স্পিয়ারহেড"…

February 26, 2025

কি ঘটেছিলো বিডিআর বিদ্রোহে! নেপথ্য কাহিনি

আলোচিত বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনি আজও অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরেও সেই রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের…

December 29, 2024

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024
Sponsored